Borshosesh kobita Rabindranath Tagore বর্ষশেষ কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

+ প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন +

Borshosesh kobita Rabindranath Tagore বর্ষশেষ কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

Bengali Poem, Borshosesh kobita lyrics written by Rabindranath Tagore বাংলা কবিতা, বর্ষশেষ লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

ঈশানের পুঞ্জমেঘ অন্ধ বেগে ধেয়ে চলে আসে

বাধাবন্ধহারা

গ্রামান্তের বেণুকুঞ্জে নীলাঞ্জনছায়া সঞ্চারিয়া,

হানি দীর্ঘধারা।

বর্ষ হয়ে আসে শেষ, দিন হয়ে এল সমাপন,

চৈত্র অবসান—

গাহিতে চাহিছে হিয়া পুরাতন ক্লান্ত বরষের

সর্বশেষ গান।

 

ধুসরপাংশুল মাঠ, ধেনুগণ ধায় ঊর্ধ্বমুখে,

ছুটে চলে চাষি,

তুরিতে নামায় পাল নদীপথে ত্রস্ত তরী যত

তীরপ্রান্তে আসি।

পশ্চিমে বিচ্ছিন্ন মেঘে সায়াহ্নের পিঙ্গল আভাস

রাঙাইছে আঁখি—

বিদ্যুৎ-বিদীর্ণ শূন্যে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলে যায়

উৎকণ্ঠিত পাখি।

 

বীণতন্ত্রে হানো হানো খরতর ঝংকারঝঞ্ঝনা,

তোলো উচ্চ সুর,

হৃদয় নির্দয় যাতে ঝঞ্ঝরিয়া ঝরিয়া পড়ুক

প্রবল প্রচুর।

ধাও গান, প্রাণ-ভরা ঝড়ের মতন ঊর্ধ্ববেগে

অনন্ত আকাশে।

উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা

বিপুল নিশ্বাসে।

 

আনন্দে আতঙ্কে মিশি, ক্রন্দনে উল্লাসে গরজিয়া,

মত্ত হাহারবে

ঝঞ্ঝার মঞ্জীর বাঁধি উন্মাদনী কালবৈশাখীর

নৃত্য হোক তবে।

ছন্দে ছন্দে পদে পদে অঞ্চলের আবর্ত-আঘাতে

উড়ে হোক ক্ষয়

ধূলিসম তৃণসম পুরাতন বৎসরের যত

নিষ্ফল সঞ্চয়।

 

মুক্ত করি দিনু দ্বার; আকাশের যত বৃষ্টিঝড়,

আয় মোর বুকে—

শঙ্খের মতন তুলি’, একটি ফুৎকার হানি দাও

হৃদয়ের মুখে।

 

বিজয়গর্জনস্বনে অভ্র ভেদ করিয়া উঠুক

মঙ্গলনির্ঘোষ,

জাগায়ে জাগ্রত চিত্তে মুনিসম উলঙ্গ নির্মল

কঠিন সন্তোষ।

 

সে পূর্ণ উদাত্ত ধ্বনি বেদগাথা সামমন্ত্র -সম

সরল গম্ভীর

সমস্ত অন্তর হতে মুহূর্তে অখণ্ড মূর্তি ধরি

হউক বাহির।

নাহি তাহে দুঃখ সুখ, পুরাতন তাপ পরিতাপ,

কম্প লজ্জা ভয়—

শুধু তাহা সদ্যস্নাত ঋজু শুভ্র মুক্ত জীবনের

জয়ধ্বনিময়।

 

হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি

পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে—

ব্যাপ্ত করি’, লুপ্ত করি’, স্তরে স্তরে স্তবকে স্তবকে

ঘনঘোরস্তূপে।

কোথা হতে আচম্বিতে মুহূর্তেকে দিক্ দিগন্তর

করি অন্তরাল

স্নিগ্ধ কৃষ্ণ ভয়ংকর তোমার সঘন অন্ধকারে

রহো ক্ষণকাল।

 

তোমার ইঙ্গিত যেন ঘনগূঢ় ভ্রূকুটির তলে

বিদ্যুতে প্রকাশে,

তোমার সংগীত যেন গগনের শত ছিদ্রমুখে

বায়ুগর্জে আসে,

তোমার বর্ষণ যেন পিপাসারে তীব্র তীক্ষ বেগে

বিদ্ধ করি হানে—

তোমার প্রশান্তি যেন সুপ্ত শ্যাম ব্যাপ্ত সুগম্ভীর

স্তব্ধ রাত্রি আনে।

 

এবার আস নি তুমি বসন্তের আবেশহিল্লোলে

পুষ্পদল চুমি,

এবার আস নি তুমি মর্মরিত কুজনে গুঞ্জনে—

ধন্য ধন্য তুমি।

রথচক্র ঘর্ঘরিয়া এসেছ বিজয়ীরাজসম

গর্বিত নির্ভয়—

বজ্রমন্ত্রে কী ঘোষিলে বুঝিলাম নাহি বুঝিলাম—

জয় তব জয়।

 

হে দুর্দম, হে নিশ্চিত, হে নূতন, নিষ্ঠুর নূতন,

সহজ প্রবল,

জীর্ণ পুষ্পদল যথা ধ্বংস ভ্রংশ করি চতুর্দিকে

বাহিরায় ফল

পুরাতন পর্ণপুট দীর্ণ করি বিকীর্ণ করিয়া

অপূর্ব আকারে

তেমনি সবলে তুমি পরিপূর্ণ হয়েছ প্রকাশ

প্রণমি তোমারে।

 

তোমারে প্রণমি আমি, হে ভীষণ, সুস্নিগ্ধ শ্যামল,

অক্লান্ত অম্লান’!

সদ্যোজাত মহাবীর, কী এনেছ করিয়া বহন

কিছু নাহি জান।

উড়েছে তোমার ধ্বজা মেঘরন্ধ্রচ্যুত তপনের

জলদর্চিরেখা—

করজোড়ে চেয়ে আছি ঊর্ধ্বমুখে, পড়িতে জানি না

কী তাহাতে লেখা।

 

হে কুমার, হাস্যমুখে তোমার ধনুকে দাও টান

ঝনন-রনন,

বক্ষের পঞ্জর ভেদি অন্তরেতে হউক কম্পিত

সুতীব্র স্বনন।

হে কিশোর, তুলে লও তোমার উদার জয়ভেরী,

করহ আহ্বান—

আমরা দাঁড়াব উঠি, আমরা ছুটিয়া বাহিরিব,

অর্পিব পরান।

 

চাব না পশ্চাতে মোরা, মানিব না বন্ধন ক্রন্দন,

হেরিব না দিক,

গণিব না দিনক্ষণ, করিব না বিতর্ক বিচার,

উদ্দাম পথিক।

মুহূর্তে করিব পান মৃত্যুর ফেনিল উন্মত্ততা

উপকণ্ঠ ভরি

খিন্ন শীর্ণ জীবনের শত লক্ষ ধিক্কার লাঞ্ছনা

উৎসর্জন করি।

 

শুধু দিনযাপনের শুধু প্রাণধারণের গ্লানি,

শরমের ডালি,

নিশি নিশি রুদ্ধ ঘরে ক্ষুদ্রশিখা স্তিমিত দীপের

ধূমাঙ্কিত কালী,

লাভক্ষতি-টানাটানি, অতিসূক্ষ্ম ভগ্ন- অংশ ভাগ,

কলহ সংশয়—

সহে না সহে না আর জীবনেরে খণ্ড খণ্ড করি

দণ্ডে দণ্ডে ক্ষয়।

 

যে পথে অনন্ত লোক চলিয়াছে ভীষণ নীরবে

সে পথপ্রান্তের

এক পার্শ্বে রাখো মোরে, নিরখিব বিরাট স্বরূপ

যুগযুগান্তের।

 

শ্যেনসম অকস্মাৎ ছিন্ন ক’রে ঊর্ধ্বে লয়ে যাও

পঙ্ককুণ্ড হতে,

মহান্ মৃত্যুর সাথে মুখামুখি করে দাও মোরে

বজ্রের আলোতে।

 

তার পরে ফেলে দাও, চূর্ণ করো, যাহা ইচ্ছা তব,

ভগ্ন করো পাখা—

যেখানে নিক্ষেপ কর হৃত পত্র, চ্যুত পুষ্পদল,

ছিন্নভিন্ন শাখা,

ক্ষণিক খেলনা তব, দয়াহীন তব দস্যুতার

লুণ্ঠনাবশেষ—

সেথা মোরে ফেলে দিয়ো অনন্ততমিস্র সেই

বিস্মৃতির দেশ।

 

নবান্ধুর ইক্ষুবনে এখনো ঝরিছে বৃষ্টিধারা

বিশ্রামবিহীন,

মেঘের অন্তরপথে অন্ধকার হতে অন্ধকারে

চলে গেল দিন।

শান্ত ঝড়ে, ঝিল্লিরবে, ধরণীর স্নিগ্ধ গন্ধোচ্ছ্বাসে,

মুক্ত বাতায়নে

বৎসরের শেষ গান সাঙ্গ করি দিনু অঞ্জলিয়া

নিশীথগগনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন। (কবিকল্পলতায় প্রকাশিত আবৃত্তি ইউটিউব ভিউজ ও সাবস্ক্রাইবার বাড়াতে সহায়তা করে)