ঝড় (কবিতা) – কাজী নজরুল ইসলাম
[পশ্চিম তরঙ্গ]
ঝড় – ঝড় – ঝড় আমি – আমি ঝড় –
শন – শন – শনশন শন –ক্কড়ক্কড় ক্কড় –
কাঁদে মোর আগমনি আকাশ বাতাস বনানীতে।
জন্ম মোর পশ্চিমের অস্তগিরি-শিরে,
যাত্রা মোর জন্মি আচম্বিতে
প্রাচী-র অলক্ষ্য পথ-পানে
মায়াবী দৈত্যশিশু আমি
ছুটে চলি অনির্দেশ অনর্থ-সন্ধানে!
জন্মিয়াই হেরিনু, মোরে ঘিরি ক্ষতির অক্ষৌহিণী সেনা
প্রণমি বন্দিল – ‘প্রভু! তব সাথে আমাদের যুগে যুগে চেনা,
মোরা তব আজ্ঞাবহ দাস –
প্রলয় তুফান বন্যা, মড়ক দুর্ভিক্ষ মহামারি সর্বনাশ!’
বাজিল আকাশ-ঘণ্টা, বসুধা-কাঁসর;
মার্তণ্ডের ধূপদানি – মেঘ-বাষ্প-ধূমে-ধূমে ভরাল অম্বর!
উল্কার হাউই ছোটে, গ্রহ উপগ্রহ হতে ঘোষিল মঙ্গল;
মহাসিন্ধু-শঙ্খে বাজে অভিশাপ-আগমনি কলকল কল কলকল কল কলকল কল!
‘জয় হে ভয়ংকর, জয় প্রলংকর’ নির্ঘোষি ভয়াল
বন্দিল ত্রিকাল-ঋষি।
ধ্যান-ভগ্ন রক্ত-আঁখি আশিস দানিল মহাকাল।
উল্লম্ফিয়া উঠিলাম আকাশের পানে তুলি বাহু,
আমি নব রাহু!
হেরিলাম সেবারতা মহীয়সী মহালক্ষ্মী প্রকৃতির রূপ,
সহসা সে ভুলিয়াছে সেবা, আগমন-ভয়ে মোর
প্রস্তর-শিখার সম নিশ্চল নিশ্চুপ!
অনুমানি যেন কোনো সর্বনাশা অমঙ্গল ভয়
জাগি আছে শিশুর শিয়র-পাশে ধ্যানমগ্না মাতা, শ্বাস নাহি বয়।
মনে হল ওই বুঝি হারা-মাতা মোর! মৌনা ওই জননীর
শুভ্র শান্ত কোলে
– প্রহ্লাদকুলের আমি কাল-দৈত্য-শিশু –
ঝাঁপাইয়া পড়িলাম ‘মা আমার’ বলে।
নাহি জানি কোন্ ফণিমনসার হলাহল-লোকে –
কোন্ বিষ-দীপ-জ্বালা সবুজ আলোকে –
নাগমাতা কদ্রু-গর্ভে জন্মেছি সহস্রফণা নাগ
ভীষণ তক্ষকশিশু! কোথা হয় নাগনাশী জন্মেজয়-যাগ –
উচ্চারিছে আকর্ষণ-মন্ত্র কোন্ গুণী –
জন্মান্তর-পার হতে ছুটে চলি আমি সেই মৃত্যু-ডাক শুনি!
মন্ত্র-তেজে পাংশু হয়ে ওঠে মোর হিংসা-বিষ-ক্রোধ-কৃষ্ণ প্রাণ,
আমার তুরীয় গতি – সে যে ওই অনাদি উদয় হতে
হিংসাসর্প-যজ্ঞমন্ত্র-টান!
ছুটে চলি অনন্ত তক্ষক ঝড় –
শন – শন – শনশন শন
সহসা কে তুমি এলে হে মর্ত্য-ইন্দ্রাণী মাতা,
তব ওই ধূলি-আস্তরণ
বিছায়ে আমার তরে জাতকের জন্মান্তর হতে?
লুকানু ও-অঞ্চল-আড়ালে, দাঁড়ালে আড়াল হয়ে মোর মৃত্যু-পথে!
ব্যর্থ হল অঞ্চল-আড়াল; বহ্নি-আকর্ষণ
মন্ত্র-তেজে ব্যাকুল ভীষণ
রক্তে রক্তে বাজে মোর – শনশন শন –
শন – শন – ওই শুন দূর –
দূরান্তর হতে মাগো, ডাকে মোরে অগ্নি-ঋষি বিষহরি সুর!
জননী গো চলিলাম অনন্ত চঞ্চল,
বিষে তব নীল হল দেহ, বৃথা মা গো দাব-দাহে পুড়ালে অঞ্চল!
ছুটে চলি মহা-নাগ, রক্তে মোর শুনি আকর্ষণী,
মমতা-জননী
দাহে মোর পড়িল মুরছি;
আমি চলি প্রলয়-পথিক – দিকে দিকে মারী-মরু রচি।
ঝড় – ঝড় – ঝড় আমি – আমি ঝড় –
শন – শন – শনশন শন –ক্কড়ক্কড় ক্কড় –
কোলাহল-কল্লোলের হিল্লোল-হিন্দোল –
দুরন্ত দোলায় চড়ি – ‘দে দোল দে দোল’
উল্লাসে হাঁকিয়া বলি, তালি দিয়া মেঘে
উন্মদ উন্মাদ ঘোর তুফানিয়া বেগে!
ছুটে চলি ঝড় – গৃহ-হারা শান্তি-হারা বন্ধ-হারা ঝড় –
স্বেচ্ছাচার-ছন্দে নাচি ! ক্কড়ক্কড় ক্কড়
কণ্ঠে মোর লুণ্ঠে ঘোর বজ্র-গিটকিরি,
মেঘ-বৃন্দাবনে মুহু ছুটে মোর বিজুরির জ্বালা-পিচকিরি!
উড়ে সুখ-নীড়, পড়ে ছায়া-তরু, নড়ে ভিত্তি রাজ-প্রাসাদের,
তুফান-তুরগ মোর উরগেন্দ্র-বেগে ধায়।
আমি ছুটি অশান্ত-লোকের
প্রশান্ত-সাগর-শোষা উষ্ণশ্বাস টানি।
লোকে লোকে পড়ে যায় প্রলয়ের ত্রস্ত কানাকানি!
ঝড় – ঝড় – উড়ে চলি ঝড় মহাবায়-পঙ্খিরাজে চড়ি,
পড়-পড় আকাশের ঝোলা শামিয়ানা
মম ধূলিধ্বজা সনে করে জড়াজড়ি!
প্রমত্ত সাগর-বারি – অশ্ব মম তুফানির খর ক্ষুর-বেগে
আন্দোলি আন্দোলি ওঠে। ফেনা ওঠে জেগে
ঝটিকার কশা খেয়ে অনন্ত তরঙ্গ-মুখে তার !
আমি যেন সাপুড়িয়া মারি মন্ত্র-মার–
ঢেউ-এর মোচড়ে তাই মহাসিন্ধু-মুখে
জল-নাগ-নাগিনিরা আছাড়ি পিছাড়ি মরে ধুঁকে!
প্রিয়া মোর ঘূর্ণিবায়ু বেদুইন-বালা
চূর্ণি চলে ঝঞ্ঝা-চুর মম আগে আগে।
ঝরনা-ঝোরা তটিনীর নটিনি-নাচন-সুখ লাগে
শুষ্ক খড়কুটো ধূলি শীত-শীর্ণ বিদায়-পাতায়
ফাল্গুনী-পরশে তার। – আমার ধমকে নুয়ে যায়
বনস্পতির মহা মহিরুহ, শাল্মলি, পুন্নাগ, দেওদার,
ধরি যবে তার
জাপটি পল্লব-ঝুঁটি, শাখা-শির ধরে দিই নাড়া;
গুমরি কাঁদিয়া ওঠে প্রণতা বনানী,
চচ্চড় করে ওঠে পাহাড়ের খাড়া শির-দাঁড়া!
প্রিয়া মোর এলোমেলো গেয়ে গান আগে আগে চলে;
পাগলিনি কেশে ধূলি চোখে তার মায়া-মণি ঝলে।
ঘাগরির ঘূর্ণা তার ঘূর্ণি-ধাঁধা লাগায় নয়নালোকে মোর।
ঘূর্ণিবালা হাসির হররা হানি বলে – ‘মনোচোর।
ধরো তো আমারে দেখি’ –
ত্রস্ত-বাস হাওয়া-পরি, বেণি তার দুলে ওঠে সুকঠিন মম ভালে ঠেকি।
পাগলিনি মুঠি মুঠি ছুঁড়ে মারে রাঙা পথধূলি,
হানে গায় ঝরনা-কুলুকুচু, পদ্ম-বনে আলুথালু খোঁপা পড়ে খুলি!
আমি ধাই পিছে তার দুরন্ত উল্লাসে;
লুকায় আলোর বিশ্ব চন্দ্র সূর্য তারা পদভর-ত্রাসে!
দীর্ঘ রাজপথ-অজগর সংকুচিয়া ওঠে ক্ষণে ক্ষণে,
ধরণি-কূর্মপৃষ্ঠ দীর্ণ জীর্ণ হয়ে ওঠে মত্ত মোর প্রমত্ত ঘর্ষণে।
পশ্চাতে ছুটিয়া আসে মেঘ ঐরাবত-সেনাদল
গজগতি-দোলা-ছন্দে; স্বরগে বাজে বাদল-মাদল!
সপ্ত সাগর শোষি শুণ্ডে শুণ্ডে তারা–
উপুড় ধরণি-পৃষ্ঠে উগারে নিযুত লক্ষ বারি-তীর-ধারা।
বয়ে যায় ধরা-ক্ষত-রসে
সহস্র পঙ্কিল স্রোত-ধার।
চণ্ডবৃষ্টি-প্রপাত-ধারা-ফুলে
বরষার বুকে ঝলে জল-মালা-হার।
আমি ঝড়, হুল্লোড়ের সেনাপতি; খেলি মৃত্যু-খেলা
ঘূর্ণনীয়া প্রিয়া-সাথে। দুর্যোগের হুলাহুলি মেলা
ধায় মম অশ্রান্ত পশ্চাতে!
মম প্রাণরঙ্গে মাতি নিখিলের শিখী-প্রাণ মুহু-মুহু মাতে!
শ্যাম স্বর্ণ পত্রে পুষ্পে কাঁপে তার অনন্ত কলাপ। –
দারুণ দাপটে মম জেগে ওঠে অগ্নিস্রাব-জ্বলন্ত-প্রলাপ
ভূমিকম্প-জরজর থরথর ধরিত্রীর মুখে!
বাসুকি-মন্দার সম মন্থনে মম সিন্ধুতট ভরে ফেনা-থুকে।
জেগে ওঠে মম সেই সৃষ্টি-সিন্ধু-মন্থন-ব্যথায়
রবি শশী তারকার অনন্ত বুদবুদ! – উঠে ভেঙে যায়
কত সৃষ্টি কত বিশ্ব আমার আনন্দ-গতিপথে।
শিবের সুন্দর ধ্রুব-আঁখি
যমের আরক্ত ঘোর মশাল-নয়ন-দীপ মম রথে।
জয়ধ্বনি বাজে মোর স্বর্গদূত ‘মিকাইলের’ আতশি-পাখায়।
অনন্ত-বন্ধন-নাগ-শিরস্ত্রাণ শোভে শিরে! শিখী-চূড়ায় তায়
শনির অশনি ওই ধূমকেতু-শিখা,
পশ্চাতে দুলিছে মোর অনন্ত আঁধার চিররাত্রি-যবনিকা!
জটা মোর নীহারিকাপুঞ্জ-ধূম পাটল পিঙ্গাস,
বহে তাহে রক্ত-গঙ্গা নিপীড়িত নিখিলের লোহিত নিষ্কাশ।
ঝড় – ঝড় – ঝড় আমি – আমি ঝড় –
ক্কড়ক্কড় ক্কড় –
বজ্র-বায়ু দন্তে-দন্তে ঘর্ষি চলি ক্রোধে!
ধূলি-রক্ত বাহু মম বিন্ধ্যাচল সম রবিরশ্মি-পথ রোধে।
ঝঞ্ঝনা-ঝাপটে মম
ভীত কূর্ম সম
সহসা সৃষ্টির খোলে নিয়তি লুকায়।
আমি ঝড়, জুলুমের জিঞ্জির-মঞ্জীর বাজে ত্রস্ত মম পায়!
ধাক্কার ধমকে মম খান খান নিষিদ্ধের নিরুদ্ধ দুয়ার,
সাগরে বাড়ব লাগে, মড়ক দুয়ার্কি ধরে আমার ধুয়ার!
কৈলাসে উল্লাস ঘোষে ডম্বরু ডিণ্ডিম
দ্রিম দ্রিম দ্রিম!
অম্বর-ডঙ্কার ডামাডোল
সৃজনের বুকে আনে অশ্রু-বন্যা ব্যথা-উতরোল।
ভাণ্ডারে সঞ্চিত মম দুর্বাসার হিংসা ক্রোধ শাপ।
ভীমা উগ্রচণ্ডা ফেলে উল্কারূপী অগ্নি-অশ্রু, সহিতে না পারি মম তাপ!
আমি ঝড়, পদতলে ‘আতঙ্ক’-কুঞ্জর, হস্তে মোর ‘মাভৈঃ’-অঙ্কুশ।
আমি বলি, ছুটে চলো প্রলয়ের লাল ঝাণ্ডা হাতে, –
হে নবীন পরুষ পুরুষ!
স্কন্ধে তোলো উদ্ধত বিদ্রোহ-ধ্বজা; কণ্টক-অশঙ্ক রে নির্ভীক!
পুরুষ ক্রন্দন-জয়ী, – দুঃখ দেখে দুঃখ পায় – ধিক তারে ধিক
আমি বলি, বিশ্ব-গোলা নিয়ে খেলো লুফোলুফি খেলা!
বীর নিক বিপ্লবের লাল-ঘোড়া,
ভীরু নিক পারে-ধাওয়া পলায়ন-ভেলা!
আমি বলি, প্রাণানন্দে পিয়ে নে রে বীর,
জীবন-রসনা দিয়া প্রাণ ভরে মৃত্যু-ঘন ক্ষীর!
আমি বলি, নরকের ‘নার’ মেখে নেয়ে আয় জ্বালা-কুণ্ড সূর্যের হাম্মামে।
রৌদ্রের-চন্দন-শুচি, উঠে বসো গগনের বিপুল তাঞ্জামে!
আমি ঝড় মহাশত্রু স্বস্তি-শান্তি-শ্রীর,
আমি বলি, শ্মশান-সুষুপ্তি শান্তি –
জয়নাদ আমি অশান্তির।
পশ্চিম হইতে পূর্বে ঝঞ্ঝনা-ঝাঁঝর
ঝঞ্ঝা-জগঝম্প ঘোর – বাজায়ে চলেছি ঝড় –
ঝনাৎ ঝনাৎ ঝন
ঝমরঝমরঝন ঝননঝননশন
শনশনশন
হুহু হুহু হুহু –
সহসা কম্পিত-কণ্ঠ-ক্রন্দন শুনি কার – ‘উহু! উহু উহু উহু!’
সজল কাজল-পক্ষ্ম কে সিক্তবসনা একা ভিজে –
বিরহিণী কপোতিনী, এলোকেশ কালোমেঘে পিঁজে।
নয়ন-গগনে তার নেমেছে বাদল, ভিজিয়াছে চোখের কাজল,
মলিন করেছে তার কালো আঁখি-তারা
বায়ে-ওড়া কেতকীর পীত পরিমল!
এ কোন্ শ্যামলী পরি পুবের পরিস্থানে কেঁদে কেঁদে যায় –
নবোদ্ভিন্ন কুঁড়ি-কদম্বের ঘন যৌবন-ব্যথায়!
জেগেছে বালার বুকে এক বুক ব্যথা আর কথা,
কথা শুধু প্রাণে কাঁদে,
ব্যথা শুধু বুকে বেঁধে, মুখে ফোটে শুধু আকুলতা!
কদম্ব তমাল তাল পিয়াল-তলায়
দূর্বাদল-মখমলে শ্যামলী-আলতা তার মুছে মুছে যায়!
বাঁধে বেণি কেয়া-কাঁটা বনে।
বিদেশিনি দেয়াশিনি একমনে দেয়া-ডাক শোনে!
দাদুরির আদুরি কাজরি
শোনে আর আঁখি-মেঘ-কাজল গড়ায়ে
দুখ-বারি পড়ে ঝরঝরি।
ঝিমঝিম রিমঝিম – রিমিরিমি রিম ঝিম
বাজে পাঁইজোর –
কে তুমি পুরবি বালা? আর যেন নাহি পাই জোর
চলা-পায়ে মোর, ও-বাজা আমারও বুকে বাজে।
ঝিল্লির ঝিমানি-ঝিনিঝিনি
শুনি যেন মোর প্রতি রক্ত-বিন্দু-মাঝে!
আমি ঝড়? ঝড় আমি? – না, না, আমি বাদলের বায়!
বন্ধু! ঝড় নাই কোথায়?
ঝড় কোথা? কই? –
বিপ্লবের লাল-ঘোড়া ওই ডাকে ওই –
ওই শোনো, শোনো তার হ্রেষার চিক্কুর,
ওই তার ক্ষুর-হানা মেঘে! –
না, না, আজ যাই আমি, আবার আসিব ফিরে,
হে বিদ্রোহী বন্ধু মোর! তুমি থেকো জেগে!
তুমি রক্ষী এ রক্ত-অশ্বের,
হে বিদ্রোহী অন্তর্দেবতা! – শুনো শুনো মায়াবিনী ওই ডাকে ফের –
পুবের হাওয়ায় –
যায় – যায় – সব ভেসে যায়
পুবের হাওয়ায় –
হায়! –