Anak akash kobita Jibanananda Das অনেক আকাশ কবিতা জীবনানন্দ দাশ

+ প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন +

Anak akash kobita Jibanananda Das অনেক আকাশ - জীবনানন্দ দাশ

 

Bengali Poem, Anak akash kobita lyrics written by Jibanananda Das বাংলা কবিতা, অনেক আকাশ লিখেছেন জীবনানন্দ দাশ

 

গানের সুরের মতো বিকালের দিকের বাতাসে

পৃথিবীর পথ ছেড়ে — সন্ধ্যার মেঘের রঙ খুঁজে

হৃদয় ভাসিয়া যায় — সেখানে সে কারে ভালোবাসে! —

পাখির মতন কেঁপে — ডানা মেলে — হিম চোখ বুজে

অধীর পাতার মতো পৃথিবীর মাঠের সবুজে

উড়ে উড়ে ঘর ছেড়ে কত দিকে গিয়েছে সে ভেসে —

নীড়ের মতন বুকে একবার তার মুখ গুঁজে

ঘুমাতে চেয়েছে, তবু — ব্যথা পেয়ে গেছে ফেঁসেঁ —

তখন ভোরের রোদে আকাশে মেঘের ঠোঁট উঠেছিল হেসে!

 

আলোর চুমায় এই পৃথিবীর হৃদয়ের জ্বর

কমে যায়; তাই নীল আকাশের স্বাদ–সচ্ছলতা–

পূর্ণ করে দিয়ে যায় পৃথিবীর ক্ষুধিত গহ্বর;

মানুষের অন্তরের অবসাদ — মৃত্যুর জড়তা

সমুদ্র ভাঙিয়া যায় — নক্ষত্রের সাথে কয় কথা

যখন নক্ষত্র তবু আকাশের অন্ধকার রাতে —

তখন হৃদয়ে জাগে নতুন যে — এক অধীরতা,

তাই লয়ে সেই উষ্ণ আকাশের চাই যে জড়াতে

গোধূলির মেঘে মেঘে, নক্ষত্রের মতো রব নক্ষত্রের সাথে!

 

আমারে দিয়েছ তুমি হৃদয়ের যে — এক ক্ষমতা

ওগো শক্তি, তার বেগে পৃথিবীর পিপাসার ভার

বাধা পায়, জেনে লয় লক্ষত্রের মতন স্বচ্ছতা!

আমারে করেছ তুমি অসহিষ্ণু — ব্যর্থ — চমৎকার!

জীবনের পারে থেকে যে দেখেছে মৃত্যুর ওপার,

কবর খুলেছে মুখ বার বার যার ইশারায়,

বীণার তারের মতো পৃথিবীর আকাঙক্ষার তার

তাহার আঘাত পেয়ে কেঁপে কেঁপে ছিড়ে শুধু যায়!

একাকী মেঘের মতো ভেসেছে সে — বৈকালের আলোয় — সন্ধ্যায়!

 

সে এসে পাখির মতো স্থির হয়ে বাঁধে নাই নীড় —

তাহার পাখায় শুধু লেগে আছে তীর — অস্থিরতা!

অধীর অন্তর তারে করিয়াছে অস্থির — অধীর!

তাহারই হৃদয় তারে দিয়েছে ব্যাধের মতো ব্যথা!

একবার তাই নীল আকাশের আলোর গাঢ়তা

তাহারে করেছে মুগ্ধ — অন্ধকার নক্ষত্র আবার

তাহারে নিয়েছে ডেকে — জেনেছে সে এই চঞ্চলতা

জীবনের; উড়ে উড়ে দেখেছে সে মরণের পার

এই উদ্বেলতা লয়ে নিশীথের সমুদ্রের মতো চমৎকার!

 

গোধূলির আলো লয়ে দুপুরে সে করিয়াছে খেলা,

স্বপ্ন দিয়ে দুই চোখ একা একা রেখেছে ঢাকি;

আকাশে আঁধার কেটে গিয়েছে যখন ভোরবেলা

সবাই এসেছে পথে, আসে নাই তবু সেই পাখি! —

নদীর কিনারে দূরে ডানা মেলে উড়েছে একাকী,

ছায়ার উপরে তার নিজের পাখায় ছায়া ফেলে

সাজায়েছে স্বপ্নের পরে তার হৃদয়ের ফাঁকি!

সূর্যের আলোর পরে নক্ষত্রের মতো আলো জ্বেলে

সন্ধ্যার আঁধার দিয়ে দিন তার ফেলেছে সে মুছে অবহেলে!

 

কেউ তারে দেখে নাই; মানুষের পথ ছেড়ে দূরে

হাড়ের মতন শাখা ছায়ার মতন পাতা লয়ে

যেইখানে পৃথিবীর মানুষের মতো ক্ষব্ধ হয়ে

কথা কয়, আকাঙক্ষার আলোড়নে চলিতেছে বয়ে

হেমন্তের নদী, ঢেউ ক্ষুধিতের মতো এক সুরে

হতাশ প্রাণের মতো অন্ধকারে ফেলিছে নিশ্বাস

তাহাদের মতো হয়ে তাহাদের সাথে গেছি রয়ে;

দূরে প’ড়ে পৃথিবীর ধূলা — মাটি — নদী — মাঠ — ঘাস —

পৃথিবীর সিন্ধু দূরে — আরো দূরে পৃথিবীর মেঘের আকাশ!

 

এখানে দেখেছি আমি জাগিয়াছ হে তুমি ক্ষমতা,

সুন্দর মুখের চেয়ে তুমি আরো ভীষণ, সুন্দর!

ঝড়ের হাওয়ার চেয়ে আরো শক্তি, আরো ভীষণতা

আমারে দিয়েছে ভয়! এইখানে পাহাড়ের পর

তুমি এসে বসিয়াছ — এই খানে অশান্ত সাগর

তোমারে এনেছি ডেকে — হে ক্ষমতা, তোমার বেদনা

পাহাড়ের বনে-বনে তুলিতেছে উত্তরের ঝড়

আকাশের চোখে-মুখে তুলিতেছে বিদ্যুতের ফণা

তোমার স্ফুলিঙ্গ আমি, ওগো শক্তি — উল্লাসের মতন যন্ত্রণা!

 

আমার সকল ইচ্ছা প্রার্থনার ভাষার মতন

প্রেমিকের হৃদয়ের গানের মতন কেঁপে উঠে

তোমার প্রাণের কাছে একদিন পেয়েছে কখন!

সন্ধ্যার আলোর মতো পশ্চিম মেঘের বুকে ফুটে,

আঁধার রাতের মতো তারার আলোর দিকে ছুটে,

সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো ঝড়ের হাওয়ার কোলে জেগে

সব আকাঙক্ষার বাঁধ একবার গেছে তার টুটে!

বিদ্যুতের পিছে পিছে ছুটে গেছি বিদ্যুতের বেগে!

নক্ষত্রের মতো আমি আকাশের নক্ষত্রের বুকে গেছি লেগে!

 

যে মুহূর্ত চলে গেছে — জীবনের যেই দিনগুলি

ফুরায়ে গিয়েছে সব, একবার আসে তারা ফিরে;

তোমার পায়ের চাপে তাদের করেছ তুমি ধূলি!

তোমার আঘাত দিয়ে তাদের গিয়েছ তুমি ছিঁড়ে!

হে ক্ষমতা, মনের ব্যথার মতো তাদের শরীরে

নিমেষে নিমেষে তুমি কতবার উঠেছিলে জেগে!

তারা সব ছলে গেছে — ভূতুড়ে পাতার মতো ভিড়ে

উত্তর — হাওয়ার মতো তুমি আজও রহিয়াছ লেগে!

যে সময় চলে গেছে তাও কাপে ক্ষমতার বিষ্ময়ে — আবেগে!

 

তুমি কাজ করে যাও, ওগো শক্তি, তোমার মতন!

আমারে তোমার হাতে একাকী দিয়েছি আমি ছেড়ে;

বেদনা — উল্লাসে তাই সমুদ্রের মতো ভরে মন! —

তাই কৌতুহল — তাই ক্ষুধা এসে হৃদয়েরে ঘেরে,

জোনাকির পথ ধরে তাই আকাশের নক্ষত্রেরে

দেখিতে চেয়েছি আমি, নিরাশার কোলে বসে একা

চেয়েছি আশারে আমি, বাঁধনের হাতে হেরে হেরে

চাহিয়াছি আকাশের মতো এক অগাধের দেখা! —

ভোরের মেঘের ঢেউয়ে মুছে দিয়ে রাতের মেঘের কালো রেখা!

 

আমিপ্রণয়িনী, তুমি হে অধীর, আমার প্রণয়ী!

আমার সকল প্রেম উঠেছে চোখের জলে ভেসে! —

প্রতিধ্বনির মতো হে ধ্বনি, তোমার কথা কহি

কেঁপে উঠে — হৃদয়ের সে যে কত আবেগে আবেশে!

সব ছেড়ে দিয়ে আমি তোমারে একাকী ভালোবেসে

তোমার ছায়ার মতো ফিরিয়াছি তোমার পিছনে!

তবুও হারায়ে গেছ, হঠাৎ কখন কাছে এসে

প্রেমিকের মতো তুমি মিশেছ আমার মনে মনে

বিদ্যুৎ জ্বালায়ে গেছ, আগুন নিভায়ে গেছ হঠাৎ গোপনে!

 

কেন তুমি আস যাও? — হে অস্থির, হবে নাকি ধীর!

কোনোদিন? — রৌদ্রের মতন তুমি সাগরের পরে

একবার — দুইবার জ্বলে উঠে হতেছ অস্থির! —

তারপর, চলে যাও কোন দূরে পশ্চিমে — উত্তরে —

ইন্দ্রধনুকের মতো তুমি সেইখানে উঠিতেছ জ্বলে,

চাঁদের আলোর মতো একবার রাত্রির সাগরে

খেলা কর — জোছনা চলে যায়, তবু তুমি যাও চলে

তার আগে; যা বলেছ একবার, যাবে নাকি আবার তা বলে!

 

যা পেয়েছি একবার, পাব নাকি আবার তা খুঁজে!

যেই রাত্রি যেই দিন একবার কয়ে গেল কথা

আমি চোখ বুজিবার আগে তারা গেল চোখ বুজে,

ক্ষীণ হয়ে নিভে গেল সলিতার আলোর স্পষ্টতা!

ব্যথার বুকের’ পরে আর এক ব্যথা — বিহ্বলতা

নেমে এল উল্লাস ফুরায়ে গেল নতুন উৎসবে;

আলো অন্ধকার দিয়ে বুনিতেছে শুধু এই ব্যথা,

দুলিতেছি এই ব্যথা — উল্লাসের সিন্ধুর বিপ্লবে!

সব শেষ হবে — তবু আলোড়ন, তা কি শেষ হবে!

 

সকল যেতেছে চলে — সব যায় নিভে — মুছে — ভেসে —

যে সুর থেমেছে তার স্মৃতি তবু বুকে জেগে রয়!

যে নদী হারায়ে যায় অন্ধকারে — রাতে — নিরুদ্দেশে,

তাহার চঞ্চল জল স্তব্ধ হয়ে কাঁপায় হৃদয়!

যে মুখ মিলায়ে যায় আবার ফিরিতে তারে হয়

গোপনে চোখের’ পরে — ব্যথিতের স্বপ্নের মতন!

ঘুমন্তের এই অশ্রু — কোন্‌ পীড়া — সে কোন্‌ বিস্ময়

জানায়ে দিতেছে এসে! — রাত্রি — দিন আমাদের মন

বর্তমান অতীতের গুহা ধরে একা একা ফিরিছে এমন!

 

আমরা মেঘের মতো হঠাৎ চাঁদের বুকে এসে

অনেক গভীর রাতে — একবার পৃথিবীর পানে

চেয়ে দেখি, আবার মেঘের মতো চুপে চুপে ভেসে

চলে যাই এক ক্ষীণ বাতাসের দুর্বল আহ্বানে

কোন্‌ দিকে পথ বেয়ে! — আমাদের কেউ কি তা জানে।

ফ্যাকাশে মেঘের মতো চাঁদের আকাশ পিছে রেখে

চলে যাই; কোন্‌ — এক রুগ্ন হাত আমাদের টানে?

পাখির মায়ের মতো আমাদের নিতেছে সে ডেকে

আরো আকাশের দিকে — অন্ধকারে, অন্য কারো আকাশের থেকে!

 

একদিন বুজিবে কি চারি দিকে রাত্রির গহ্বর!

নিবন্ত বাতির বুকে চুপে চুপে যেমন আঁধার

চলে আসে, ভালোবেসে — নুয়ে তার চোখের উপর

চুমো খায়, তারপর তারে কোলে টেনে লয় তার —

মাথার সকল স্বপ্ন, হৃদয়ের সকল সঞ্চার

একদিন সেই শূন্য সেই শীত — নদীর উপরে

ফুরাবে কি? দুলে দুলে অন্ধকারে তবুও আবার

আমার রক্তের ক্ষুধা নদীর ঢেউয়ের মতো স্বরে

গান গাবে, আকাশ উঠিবে কেঁপে আবার সে সংগীতের ঝড়ে!

 

পৃথিবীর — আকাশের পুরানো কে আত্মার মতন,

জেগে আছি; বাতাসের সাথে সাথে আমি চলি ভেসে,

পাহাড়ে হাওয়ার মতো ফিরিতেছে একা একা মন,

সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো দুপুরের সমুদ্রের শেষে

চলিতেছে; কোন্‌ — এক দূর দেশ — কোন্‌ নিরুদ্দেশে

জন্ম তার হয়েছিল — সেইখানে উঠেছে সে বেড়ে;

দেহের ছায়ার মতো আমার মনের সাথে মেশে

কোন্‌ স্বপ্ন? — এ আকাশ ছেড়ে দিয়ে কোন্‌ আকাশেরে

খুঁজে ফিরি! — গুহার হাওয়ার মতো বন্দি হয়ে মন তব ফেরে!

 

গাছের শাখার জালে এলোমেলো আঁধারের মতো

হৃদয় খুঁজিছে পথ, ভেসে ভেসে — সে যে কারে চায়!

হিমেল হাওয়ার হাত তার হাড় করিছে আহত,

সেও কি শাখার মতো — পাতার মতন ঝরে যায়!

বনের বুকের গান তার মতো শব্দ করে গায়!

হৃদয়ের সুর তার সে যে কবে ফেলেছে হারায়ে!

অন্তরের আকাঙ্ক্ষারে — স্বপনেরে বিদায় জানায়

জীবন মৃত্যুর মাঝে চোখ বুজে একাকী দাঁড়ায়ে;

ঢেউয়ের ফেনার মতো ক্লান্ত হয়ে মিশিবে কি সে — ঢেউয়ের গায়ে!

 

হয়তো সে মিশে গেছে — তারে খুঁজে পাবে নাকো কেউ!

কেন যে সে এসেছিল পৃথিবীর কেহ কি তা জানে!

শীতের নদীর বুকে অস্থির হয়েছে যেই ঢেউ

শুনেছে সে উষ্ণ গান সমুদ্রের জলের আহ্বানে!

বিদ্যুতের মতো অল্প আয়ু তবু ছিল তার প্রাণে,

যে ঝড় ফুরায়ে যায় তাহার মতন বেগ লয়ে

যে প্রেম হয়েছে ক্ষুব্ধ সেই ব্যর্থ প্রেমিকের গানে

মিলায়েছে গান তার, তারপর চলে গেছে রয়ে।

সন্ধ্যার মেঘের রঙ কখন গিয়েছে তার অন্ধকার হয়ে!

 

তবুও নক্ষত্র এক জেগে আছে, সে যে তারে ডাকে!

পৃথিবী চায় নি যারে, মানুষ করেছে যারে ভয়

অনেক গভীর রাতে তারায় তারায় মুখ ঢাকে

তবুও সে! কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়

তাহার মানুষ চোখে ছবি দেখে একা জেগে রয়!

মানুষীর মতো? কিংবা আকাশের তারাটির মতো —

সেই দূর — প্রণয়িনী আমাদের পৃথিবীর নয়!

তার দৃষ্টি — তাড়নায় করেছে যে আমারে ব্যাহত —

ঘুমন্ত বাঘের বুকে বিষের বাণের মতো বিষম সে ক্ষত!

 

আলো আর অন্ধকারে তার ব্যথা — বিহ্বলতা লেগে,

তাহার বুকের রক্তে পৃথিবী হতেছে শুধু লাল! —

মেঘের চিলের মতো — দুরন্ত চিতার মতো বেগে

ছুটে যাই — পিছে ছুটে আসিতেছে বৈকাল — সকাল

পৃথিবীর — যেন কোন্‌ মায়াবীর নষ্ট ইন্দ্রজাল

কাঁদিতেছে ছিঁড়ে গিয়ে! কেঁপে কেঁপে পড়িতেছে ঝরে!

আরো কাছে আসিয়াছি তবু আজ — আরো কাছে কাল

আসিব তবুও আমি — দিন রাত্রি রয় পিছে পড়ে —

তারপর একদিন কুয়াশার মতো সব বাধা যাবে সরে!

 

সিন্ধুর ঢেউয়ের তলে অন্ধকার রাতের মতন

হৃদয় উঠিতে আছে কোলাহলে কেঁপে বারবার!

কোথায় রয়েছে আলো জেনেছে তা, বুঝেছে তা মন —

চারি দিকে ঘিরে তারে রহিয়াছে যদিও আঁধার!

একদিন এই গুহা ব্যথা পেয়ে আহত হিয়ার

বাঁধন খুলিয়া দেবে! অধীর ঢেউয়ের মতো ছুটে

সেদিন সে খুঁজে লবে অই দুরে নক্ষত্রের পার!

সমুদ্রের অন্ধকারে গহ্বরের ঘুম থেকে উঠে

দেখিবে জীবন তার খুলে গেছে পাখির ডিমের মতো ফুটে!

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন। (কবিকল্পলতায় প্রকাশিত আবৃত্তি ইউটিউব ভিউজ ও সাবস্ক্রাইবার বাড়াতে সহায়তা করে)