অন্ধবিলাপ – শঙ্খ ঘোষ

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

ধৃতরাষ্ট্র বললেন :

 

ধর্মক্ষেত্রে রণক্ষেত্রে সমবেত লোকজনেরা

সবাই মিলে কী করল তা বলো আমায় হে সঞ্জয়

 

অন্ধ আমি দেখতে পাই না, আমিই তবু রাজ্যশিরে

কাজেই কোথায় কী ঘটছে তা সবই আমায় জানতে হবে

 

সবই আমায় বুঝতে হবে কার হাতে কোন অস্ত্র মজুত

কিংবা কে কোন্ লড়াইধাঁচে আড়াল থেকে ঘাপটি মারে

 

অন্ধ আমি, দেখতে পাই না, আমিই তবু রাজ্যশিরে

এবং লোকে বলে এদেশ যে তিমিরে সেই তিমিরে

 

কারা এসব রটিয়ে বেড়ায় বলো আমায় হে সঞ্জয়

অন্ধ আমি, কিন্তু তবু এসব আমায় জানতে হবে

 

তেমন তেমন তম্বি করলে বাঁচবে না একজনার পিঠও

জানিয়ে দিয়ো খুবই শক্ত বল্গাতে এই রাষ্ট্র ধৃত

 

অসম্ভবের কুলায় আমার পালক দিয়ে বুলিয়ে যাবে

সেই আশাতে ঘর বাঁধিনি, দুর্যোধনরা তৈরি আছে

 

এবং যত বৈরী আছে তাদের মগজ চিবিয়ে খাবে

খাচ্ছে কি না সেই কথাটা জানাও আমায় হে সঞ্জয়

 

সামান্য এক ছটাক জমি ছাড়বে কেন আমার ছেলে

আমার সঙ্গে ভূমিসেনা আমার সঙ্গে ভূস্বামীরা

 

আমার সঙ্গে দ্রোণ বা কৃপ আমার সঙ্গে ভীষ্মবিদুর

সেদিক থেকে দেখতে গেলে ধর্মরাজ্য এমন কী দূর

 

দুষ্টে বলে, মনে মনে তারা আমার কেউ না কি নয়

সেটাও যদি সত্যি হয় তো একাই একশো আমার ছেলে

 

তারাই জানে শমনদমন, ধ্বংস দিনে ধ্বংস রাতে

ছড়িয়ে যাবে ঘটল যা সব আরওয়ালে কানসারাতে

 

যে যা করে তাকে তো তার নিশ্চিত ফল ভুগতে হবে

কোথায় যাবে পালিয়ে, দেখো সামনে আমার সৈন্যব্যূহ

 

তিনদিকে তিন দেয়াল ঘেরা সাতান্ন রাউন্ড গান্ধীমাঠে

ভিজল মাটি ভিজল মাটি ভিজুক মাটি রক্তপাতে।

 

অধর্ম? কে ধর্ম মানে? আমার ধর্ম শত্রুনাশন

নিরস্ত্রকে মারব না তা সবসময় কি মানতে পারি?

 

মারব না কি নির্ভুমিকে? নিরন্নকে? নিরস্ত্রকে?

অবশ্য কেউ মেরেছিল সেটাই বা কে প্রমাণ করে!

 

এখন আমার মনে পড়ে বেদব্যাস যা বলেছিলেন

সৈন্যে শস্ত্র ছুঁড়ছে তা নয়- কোষ থেকে তা আপনি ছোটে

 

মাঝেমাঝেই ছুটবে এমন- ব্যাস তো জানেন আমার দশা

এই যে আমার একশো ছেলে- কেউ বশে নয় এরা আমার

 

এইরকমই অন্ধ আমি, আমিই তবু রাজ্যশিরে

–কিন্তু কারা শপথ নিল নিজেরই হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে?

 

ধানজমিতে খাসজমিতে সমবেত লোকজনেরা

ধেয়ে আসছে সামন্তদের– কেন এ দুঃস্বপ্ন দেখি?

 

পুব থেকে পশ্চিমের থেকে উত্তরে বা দক্ষিণে কে

অক্ষৌহিণী ঘিরবে বলে ফন্দি করে আসছে ঝেঁপে?

 

লোহার বর্মে সাজিয়ে রাখি কেউ যেন না জাপটে ধরে

স্বপ্নে তবু এগিয়ে আসে নারাচ ভল্ল খড়্গ তোমর–

 

এখন আমার মনে পড়ে বেদব্যাস যা বলেছিলেন

নিদেনকালে সমস্তদিক নাশকচিহ্নে ছড়িয়ে যাবে

 

সন্ধ্যাকাশে দুই পাশে দুই শাদালালের প্রান্ত নিয়ে

কৃষ্ণগ্রীব মেঘ ঘুরবে বিদ্যুদ্দামমণ্ডিত

 

বাজশকুনে হাড়গিলেতে ভরবে উঁচু গাছের চুড়ো

তাকিয়ে থাকবে লোহার ঠোঁটে খুবলে খাবে মাংস কখন

 

মেঘ ঝরাবে ধুলো, মেঘেই মাংসকণা ছড়িয়ে যাবে

হাতির পিঠে লাফিয়ে যাবে বেলেহাঁস আর হাজার ফড়িং

 

কাজেই বলো, হে সঞ্জয়, কোন্ দিকে কার পাল্লা ভারী?

জিতব? না কি নিদেনকালের জাঁতায় পিষে মরব এবার?

 

সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধেক কি ছাড়তে হবে?

টুকরো টুকরো করব কি দেশ পিছিয়ে গিয়ে সগৌরবে?

 

যে যাই বলুক এটাই ধ্রুব- আমার দিকেই ভিড়ছে যুব

তবুও শুধু ব্যাস যা বলেন সেটাই কি সব ফলবে তবে?

 

ফলুক, তবু শেষ দেখে যাই, ন্যাংটার নেই বাটপাড়ে ভয়

ইঙ্গিতে-বা বলছে লোকে আমার না কি মরণদশা

 

বাজশকুনে হাড়গিলেতে তাকিয়ে আছে লোহার ঠোঁটে–

ধানজমিতে খাসজমিতে জমছে লোকে কোন্ শপথে

 

কিসের ধ্বনি জাগায় দূরে দিকে এবং দিগন্তরে

দেবদত্ত পাঞ্চজন্য মণিপুষ্পক পৌণ্ড্র সুঘোষ

 

শেষের সে-রোষ ভয়ংকরী সেই কথাটা বুঝতে পারি

কিন্তু তবু অন্ধ আমি, ব্যাসকে তো তা বলেইছিলাম

 

বলেছিলাম এটাই গতি, ভবিতব্য এটাই আমার

আমার পাপেই উশকে উঠবে হয়তো-বা সব খেত বা খামার

 

আমার পাপেই উশকে উঠুক মহেশ্বরের প্রলয়পিনাক

সর্বনাশের সীমায় সবাই যায় যদি তো শেষ হয়ে যাক

 

কোন্ খেতে বা কোন্ খামারে সমবেত লোকজনেরা

জমছে এসে শস্ত্রপাণি বলো আমায় হে সঞ্জয়

 

সমবেত লোকজনেরা কোথায় কখন কী করছে তা

শোনাও আমায়, অন্ধ আমি, শোনাও আমায় হে সঞ্জয়

 

শোনাও আমায় শোনাও আমায় শেষের সেদিন হে সঞ্জয়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।