সৃষ্টির তীরে (কবিতা) – জীবনানন্দ দাশ

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

বিকেলের থেকে আলো ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে নিভে যায়— তবু

ঢের স্মরণীয় কাজ শেষ হ’য়ে গেছে:

হরিণ খেয়েছে তার আমিষাশী শিকারীর হৃদয়কে ছিঁড়ে;

সম্রাটের ইশারায় কঙ্কালের পাশাগুলো একবার সৈনিক হয়েছে;

সচ্ছল কঙ্কাল হ’য়ে গেছে তারপর;

বিলোচন গিয়েছিলো বিবাহ-ব্যাপারে;

প্রেমিকেরা সারাদিন কাটায়েছে গণিকার বারে;

সভাকবি দিয়ে গেছে বাক্‌বিভূতিকে গালাগাল।

সমস্ত আচ্ছন্ন সুর একটি ওঙ্কার তুলে বিস্মৃতির দিকে উড়ে যায়।

এ-বিকেল মানুষ না মাছিদের গুঞ্জরণময়!

যুগে-যুগে মানুষের অধ্যবসায়

অপরের সুযোগের মতো মনে হয়।

কুইসলিং বানালো কি নিজ নাম— হিটলার সাত কানাকড়ি

দিয়ে তাহা কিনে নিয়ে হ’য়ে গেল লাল:

মানুষেরই হাতে তবু মানুষ হতেছে নাজেহাল;

পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি।

এ কেমন পরিবেশে র’য়ে গেছি সবে—

বাক্‌পতি জন্ম নিয়েছিলো যেই কালে,

অথবা সামান্য লোক হেঁটে যেতে চেয়েছিলো স্বাভাবিক ভাবে পথ দিয়ে,

কি ক’রে তা হ’লে তা’রা এ-রকম ফিচেল পাতালে

হৃদয়ের জনপরিজন নিয়ে হারিয়ে গিয়েছে?

অথবা যে-সব লোক নিজের সুনাম ভালোবেসে

দুয়ার ও পরচুলা না এঁটে জানে না কোনো লীলা,

অথবা যে-সব নাম ভালো লেগে গিয়েছিলো: আপিলা চাপিলা

—রুটি খেতে গিয়ে তা’রা ব্রেডবাস্কেট খেলো শেষে।

এরা সব নিজেদের গণিকা, দালাল, রেস্ত, শত্রুর খোঁজে

সাতপাঁচ ভেবে সনির্বন্ধতায় নেমে আসে;

যদি বলি, তা’রা সব তোমাদের চেয়ে ভালো আছে;

 

অসৎপাত্রের কাছে তবে তা’রা অন্ধ বিশ্বাসে

কথা বলেছিলো ব’লে দুই হাত সতর্কে গুটায়ে

হ’য়ে ওঠে কি যে উচাটন!

কুকুরের ক্যানারির কান্নার মতন:

তাজা ন্যাকড়ার ফালি সহসা ঢুকেছে নালি ঘায়ে।

ঘরের ভিতর কেউ খোয়ারি ভাঙছে ব’লে কপাটের জং

নিরস্ত হয় না তার নিজের ক্ষয়ের ব্যবসায়ে,

আগাগোড়া গৃহকেই চৌচির করেছে বরং;

অরেঞ্জপিকোর ঘ্রাণ নরকের সরায়ের চায়ে

ক্রমেই অধিক ফিকে হ’য়ে আসে; নানারূপ জ্যামিতিক টানের ভিতরে

স্বৰ্গ মর্ত্য পাতালের কুয়াশার মতন মিলনে

একটি গভীর ছায়া জেগে ওঠে মনে;

অথবা তা’ ছায়া নয়— জীব নয় সৃষ্টির দেয়ালের ’পরে।

আপাদমস্তক আমি তার দিকে তাকায়ে রয়েছি;

গগ্যাঁর ছবির মতো— তবু গগ্যাঁর চেয়ে গুরু হাত থেকে

বেরিয়ে সে নাকচোখে ক্বচিৎ ফুটেছে টায়ে-টায়ে;

নিভে যায়— জ্ব’লে ওঠে, ছায়া, ছাই, দিব্যযোনি মনে হয় তাকে।

স্বাতিতারা শুকতারা সূর্যের ইস্কুল খুলে

সে-মানুষ নরক বা মর্ত্যে বাহাল

হ’তে গিয়ে বৃষ মেষ বৃশ্চিক সিংহের প্রাতঃকাল

ভালোবেসে নিতে যায় কন্যা মীন মিথুনের কুলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।