Tej poem lyrics Debabrata Singha তেজ (কবিতা) – দেবব্রত সিংহ

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

Tej poem lyrics Debabrata Singha - তেজ - দেবব্রত সিংহ

 

আমি জামবনির কুঁইরিপাড়ার

শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি,

কাগজআওলারা বললেক,

উহুঁ অতটুকু্ন বললে হবেক কেনে

তুমি ইবারকার মাধ্যমিকে পথম

তুমাকে বলতে হবেক আরঅ কিছু।

টিভিআওলারা বললেক,

তুমি খেতমজুরের মেইয়া

তুমি কী করে কামীন খাটে মাধ্যমিকে পথম হলে

সেটা তুমাকে বলতে হবেক খুলে।

পঞ্চায়েতের অনি বউদি, পধান, উপপধান, এম.এল.এ., এম.পি.

সবাই একবারি হামলিয়ে পড়ল আমাদের মাটির কুঁড়াঘরে।

জামবনি ইস্কুলের হেডমাস্টার কোন বিহানবেলায়

টিনের আগর খুলে

হাঁকে ডাকে ঘুম ভাঙাই

খবরটা যখন পথম শুনালেক

তখন মা’কে জড়াই শুয়েছিলম আমি,

কুঁড়াঘরের ঘুটঘুটা অন্ধকারে

হেডমাস্টার’কে দেখে

মায়ের পারা আমিও চোখ কচালে হাঁ হয়্যে ভালেছিলম

ইকি স্বপুন দেখছি ন’কি,

সার বললেক, ইটা স্বপুন লয় সত্যি বঠে।

কথাটা শুনে কাঁদে ভাসাইছিলম আমরা দু মা বিটি

আজ বাপ বেঁচে থাকলে 

মানুষটাকে দেখাতে পারথম

আমি দেখাতে পারথম বহুত কিছু

আমার বুকের ভিতরে যে তেজালঅ সনঝাবাতিটা

জ্বালে দিয়েছিল মানুষটা

সেই বাতিটা আজকে কেমন আমাদে কুঁড়া ঘরটাকে

আলো করেছে সেটা দেখাতে পারথম।

আপনারা বলছেন বঠে

কথাটা শুনতে কিন্তুক খুব ভালঅ,

‘তুমাদে মতন মেইয়ারা যদি উঠে আসে

তাহালে আমাদে গোটা দেশটাই উঠে আসে।’

কিন্তুক উঠে আসার রাস্তাটা যে আখনো তয়ার হয় নাই

খাড়া পাহাড়ে উঠা যে কী জিনিস

বহুত দম লাগে

বহুত তেজ লাগে।

আমি জামবনির শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি

যখন থাকে হুঁশ হইছে তখন থাকে শুনে আসছি

‘বিটি না মাটি’,

ঠাকুমা বলথক,

‘পরের ঘরে হিঁসাল ঠেলবেক তার আবার লেখাপড়া’

গাঁয়ের বাবুরা বলথক,

‘তুই কুঁইরিপাড়ার বিটিছেলা

তোর কামীনখাটা ছাড়া গতি কী।’

বাপ বলথক, ‘দেখ সাঁঝলি

মনখারাপ করলি তো হারে গেলি

শুন যে যা বলছে বলুক

ইসব কথা এক কানে সিমালে

আর এক কানে বার করে দিবি।’

তখেন আমাদে বাবুপাড়ার কুচিল দেঘরার ঘরে

কামীন খাটতক মা

ক্ষয় রোগের তাড়সে মায়ের গতরটা ভাঙে নাই অতটা

মাঝে মধ্যে জ্বর টর আসত

জ্বর আল্যে মা চুপচাপ এগনাতে তালাই পাতে

শুয়ে থাকত,

মনে আছে সে ছিল এক জাড়কালের সকাল

রোদ উঠেছিল ঝলমলানি

ঝিঙাফুলা রোদ,

আমি সে রোদে পিঠ দিয়ে গা দুলাই পড়ছিলাম

ইতিহাস

ক্লাস সেভেনের সামন্ত রাজাদের ইতিহাস।

দেঘরাগিন্নি লোক পাঠাইছিল বারকতক

মায়ের জ্বর

সে তারা শুনতে নাই চায়

আমাদে দিদিবুড়ি তখনো বাঁচে

কুলতলায় বসে ছেঁড়া কম্বল মুড়ি দিয়ে

বিড়ি ফুঁকছিল বুড়ি

শেষতক বুড়ি সেদিন পড়া থাকে উঠাই

মায়ের কাজটুকুন করতে পাঠাইছিল বাবুঘরে।

পুরনঅ ফটক ঘেরা উঠান

অতবড় দরদালান

অতবড় বারান্দা,

সব ঝাঁটপাট দিয়ে সাফসুতরা করে

আসছিলুম চল্যে,

দেঘরাগিন্নি নাই ছাড়লেক

একগাদা এঁটোকাটা জুঠা বাসন

আমার সামনে আনে ধরে দিলেক।

বললাম, ‘তুমাদে জুঠা বাসন আমি ধুতে নাই পারব’

বাবুগিন্নির সেকি রাগ,

‘কি বললি

আরেকবার বল দেখনি,

যতটুকুন মু লয় তত বড় কথা

জানিস তোর মা, তোর মায়ের মা, তার মায়ের মা

সবাই আমাদের জুঠা বাসন ধুইয়ে

আতক্কাল গুজারে গেল

আর তুই আমাদের জুঠা বাসন ধুতে লারবি?’

বললাম, ‘হু, তুমাদে জুঠা বাসন আমি ধুতে লারব

তুমরা লোক দেখে লাও গা

আমি চললাম।’

কথাটা বল্যে গটগট করে

বাবুগিন্নির মুখের সামনে

আমি বেরাই চল্যে আইছিলম।

তাবাদে সে লিয়ে কি কান্ড কি ঝামালা

বেলা ডুবলে মাহাতোদে ধান কাটে

বাপ ঘরকে আলে

দুপাতা লেখাপড়া করা লাতনীর

ছোট মুখে বড়ো থুতির কথা

সাতকাহন করে বলেছিল দিদিবুড়ি,

মা কোনো রা কাড়ে নাই

আঘনমাসের সনঝাবেলায় এগনাতে আগুন জ্বাল্যে

গা হাত পা সেঁকছিল মা,

একমাথা ঝাঁকড়া কালো চুল ঝাঁকানো বাপের

পেটানো পাথরের মুখটা

ঝলকে উঠেছিল আগুনের আঁচে।

বাপের অমন চেহারা

আমি কোনোদিন দেখি নাই

বাপ সেদিন মা আর দিদি বুড়ির সমুখে

আমাকে কাছকে ডাকে

মাথায় হাত বুলাই গমগমা গলায় বলেছিল,

‘যা করেছিস বেশ করেছিস,

শুন, তোর মা, তোর মায়ের মা, তার মায়ের মা

সবাই করেছে কামীনগিরি

বাবুঘরে গতর খাটাই খাইছে

তাতে হইছে টা কী,

ই কথাটা মনে রাখবি সাঝলি

তুই কিন্তুক কামীন হবার লাগে জন্মাস নাই

যতবড় লাটসাহেবই হোক কেননে

কারু কাছে মাথা নুয়াই নিজের তেজ বিকাবি নাই,

এই তেজটুকুনের লাগে লেখাপড়া শিখাচ্ছি তোকে

নাহলে আমাদে পারা হাভাতা মানুষের ঘরে

আর আছে টা কী।’

আমি জামবনির কুইরি পাড়ার

শিবু কুইরির বিটি সাঁঝলি,

কবেকার সেই কেলাস সেভেনের কথা ভাবতে যাইয়ে

কাগজআওলা টিভিআওলাদের সামনে আখন

কি যে বলি,

তালপাতার রদ দিয়ে ঘেরা গোবুরলাতার এগনাতে

লোকে এখন লোকাকার।

তার মাঝে বাঁশি বাজাই জীবগাড়িতে চাপে

আগু পেছু পুলিশ লিয়ে মন্ত্রী আলেক ছুটে,

‘কোথায় সাঁঝলি কুঁইরি কোথায়’

বলতে বলতে বন্দুকধারী পুলিশ লিয়ে

সোজা আমাদে মাটির কুঁড়াঘরে।

হেড সার বললেক ,‘প্রনাম কর সাঁঝলি প্রনাম কর’,

মন্ত্রী তখন পিঠ চাপড়ালেক

পিঠ চাপরাই বইললেক,

‘তুমি কামীন খাটে মাধ্যমিকে প্রথম

তাই তুমাকে দেখতে আলম

সত্যি বড় গরিব অবস্থা

তুমাদে মতন গরিব ঘরের মেয়েরা যাতে উঠে আসে

তার লাগে তো আমাদের পার্টি

তার লাগে আমাদের সরকার

নাও দশ হাজার টাকার চেকটা আখন নাও

শোন আমরা তোমাকে আরো টাকা তুলে দেব

ফুল দেব সম্বর্ধনা দেব

এই টিভির লোক, কাগজের লোক, কারা আছেন

এদিকে আসুন।’

তক্ষুনি ছোট বড় কতরকমের সব ঝলকে উঠল ক্যামেরা

ঝলকে উঠল মন্ত্রীর মুখ

না-না মন্ত্রী লয়

ঝলকে উঠল আমার বাপের মুখ

গনগনা আগুনের পারা আগুন মানুষের মুখ

আমি তখুনি বলে উঠলম,

না-না ই টাকা আমার নাই লাগবেক

আর আমাকে যে ফুল দিবেন সম্বর্ধনা দিবেন

আরও দেদার টাকা তুলে দিবেন

তাও আমার নাই লাগবেক।

মন্ত্রী তখন ঢোক গিললেক

গাঁয়ের সেই দেঘর‍াগিন্নির বড়বেটা

সে এখন পাটির বড় লেতা

ভিড় ঠেলে সে আস্যে বললেক,

‘ক্যানে, কি হইছেরে সাঁঝলি,

তুই ত আমাদে ঘরে কামীন ছিলি

বল তর লাগে আমরা কী করতে পারি বল

তোর কী লাগবেক সেটা খুলে বল।’ 

বললাম, ‘আমার পারা শয়ে শয়ে আরো অনেক

সাঁঝলি আছে

আরো শিবু কুঁইরির বিটি আছে গাঁ গেরামে

তারা যদ্দিন অন্ধকারে পড়ে থাকবেক

তারা যদ্দিন লেখাপড়ার লাগে কাঁদে বুলবেক

তদ্দিন কোনো বাবুর দয়া নাই লাগবেক

তদ্দিন কোনো বাবুর দয়া আমার নাই লাগবেক।’

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।