কলকাতা, প্রিয় কলকাতা (কবিতা) – তসলিমা নাসরিন

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

কলকাতা, কেমন আছ তুমি? কেমন আছে তােমার চৌরঙ্গি, গড়ের মাঠ,

ইডেন গার্ডেন, কেমন আছে হাওড়া ব্রিজ ? শ্যামবাজার ?

গড়িয়াহাটের মােড়? ধর্মতলা ?

কথা ছিল চিৎপুরের রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটব, জীবন দেখতে দেখতে যাব খড়কুটোর,

মানুষের, কথা ছিল ফুটপাতের তেলেভাজা, কলবেরুনাে ছােলাসেদ্ধ, আলুকাবলি,

লংকার আচার খেয়ে হাইড্র্যান্টের ভিড়ে দাড়িয়ে আঁজলা ভরে পান করব জল,

হাওড়া স্টেশনে যােলাে রকম মানুষের গাধাক্কা খেতে খেতে হাঁটব,

 

হুইসেল শুনে দৌড়ে ধরব ট্রেনের।

হ্যান্ডেল। ট্রেন যাবে বােলপুর দুর্গাপুর জয়পুর… কী কী সব পুরের দিকে।

কথা ছিল দেশপ্রিয় পার্কের ঘাসে শুয়ে কচ্ছপের মতাে হেঁটে-আসা ট্রাম দেখব,

ট্রাম দেখব আর জীবনানন্দের জন্য আমার মায়া হবে খুব।

কখনও খিদে-পেটে বসন্ত কেবিনের কাটলেট,

কখনও গিরিশমঞ্চে নাটক, নন্দনে সত্যজিতের ছবি,

সারা দুপুর পড়ে থাকব বইয়ের ওপর উবু হয়ে বইপাড়ায়,

 

কফি হাউজে ঠান্ডা কফি সামনে নিয়ে ঈশ্বরের চেয়ে বেশি ভাবব ঈশ্বরচন্দ্রের কথা।

কথা ছিল। কথা কার সঙ্গে ছিল আমার?

রবীন্দ্রসদন? লেকের জল ? মেমােরিয়াল ? মনুমেন্ট? কার সঙ্গে?

নাকি ওই কালাে পাথরের মাতঙ্গিনী হাজরার সঙ্গে কাকপক্ষী দেখেনি কথা হয়েছিল?

চুপিচুপি কাকে যে আমি কথা দিয়েছি যাব চুমু খাব দৌড়ব।

 

ব্রহ্মপুত্রের মতাে দেখতে গঙ্গার দিকে

গঙ্গার হাওয়ার দিকে তীরের বালুর দিকে।

ভে-বাজা লঞ্চের দিকে…

কলকাতায় কারা তােমরা ব্রহ্মপুত্রের লোেক গাে,

কারা তােমরা পদ্ম যমুনা সুরমা তিতাস আর শীতলক্ষার।

ছলছল জল দেখেছিলে? তুমি, নয় তােমার বাবা, নয় তােমার ঠাকুর্দা

তােমরা আমার গা থেকে কংসের গন্ধ নেবে নাও,

আমার নাকের ঘামে কর্ণফুলি, চোখে আস্ত একটি মেঘনা…

কথা কার সঙ্গে হয়েছিল আমার? মেট্রো রেল ? শুকনাে বকুল ?

নাকি নিজের সঙ্গে নিজেরই ?

আমার আঙুল কাপে তিরতির তৃষ্ণায়, কতদিন ছুই না কলকাতার চিবুক—

তার রােদে ভিজে বাড়ি ফিরি না,

কতদিন কেউ ঘুম পাড়ায় না সুতানটি গ্রামে পর্তুগিজ দস্যু আর

ইংরেজ বেনিয়ার ছড়ি-ঘােরানাে আঙুল আর

লালচক্ষুর গল্প শােনাতে শােনাতে,

কতদিন কুয়াশা কেটে দৌড়নাে হয় না এসপ্লানেডের ফুটপাথ ধরে সােজা…

আমার গা হাত পা শক্ত শেকলে বাঁধা, আমি তােমাকে একবার ছোবার জন্য

কাদছি কলকাতা, কঁদছি বলে লােকে আমাকে দুয়াে দিচ্ছে,

ধুয়ে দিচ্ছে…

তােমাকে ভালবাসি বলে লােকে আমাকে ঢিল ছুড়ছে, কাদা ছুড়ছে, চোখের ভেতর

ঢেলে দিচ্ছে গােলমরিচের গুঁড়াে, মুখে পুরে দিচ্ছে

একতাল গােবর, ভরদুপুরে ন্যাংটো করছে খােলা রাস্তায়…

 

কবে আমাদের দেখা হবে কলকাতা? সামনের শীতে, বসন্তে ?

নাকি বসন্ত যাবে, ঝরাপাতার ওপর মরমর হাঁটবে ভুইফোড় ইদুর,

বর্ষায় চুপসে যাবে রাসবিহারী এভিন্যু, তার যে গা মুছিয়ে দেব, যাওয়া হবে না;

বালিগঞ্জের আকাশে তুলাে তুলাে মেঘ জমবে।

আর আমি বসে থাকব একা দরজা জানালা সাঁটা অন্ধকার ঘরে শ্বাস

ফেলার শব্দ যেন কেউ না শােনে এমন নিঃশব্দে, আমার আর লেজআলা

ঘুড়ির পেছনে সারা বিকেল ছােটা হবে না,

স্বপ্নগুলাে লাটাইয়ে পেঁচাতে পেঁচাতে শখের বয়স ফুরােবে…

মল্লিকাদের সঙ্গে কথা ছিল দলবেঁধে গােল্লাছুট খেলব আবার,

মাঠ পড়ে আছে খরখরে, খােয়া ফেলা, খেলা হবে না;

প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে একজন খুব হৃদয়বান মানুষের সামনে চেয়ার পেতে বসে

দুটো কষ্টের কথা বলার ছিল, বলা হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।