Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors
Search in posts
Search in pages

Na pathano chithi kobita lyrics না পাঠানো চিঠি কবিতা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

+ প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন +

Na pathano chithi kobita lyrics না পাঠানো চিঠি কবিতা - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

 

Bengali Poem (Bangla Kobita), Na pathano chithi written by Sunil Gangopadhyay বাংলা কবিতা, না পাঠানো চিঠি লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

 

মা, তুমি কেমন আছ?

আমার পোষা বেড়াল খুনচু, সে কেমন আছে

সে রাত্তিরে কার পাশে শোয়

দুপুরে যেন আলি সাহেবদের বাগানে না যায়

মা, ঝিঙে মাচায় ফুল এসেছে?

তুলিকে আমার ড়ুরে শাড়িটা পরতে বলো

আঁচলের ফেঁসোটা যেন সেলাই করে নেয়

তুলিকে কত মেরেছি, আর কোনওদিন মারব না

আমি ভালো আছি, আমার জন্য চিন্তা করো না

মা, তোমাদের ঘরের চালে নতুন খড় দিয়েছ?

এবারে বৃষ্টি হয়েছে খুব

তরফদারবাবুদের পুকুরটা কি ভেসে গেছে?

কালু-ভুলুরা মাছ পেয়েছে কিছু?

একবার মেঘের ডাক শুনে কই মাছ উঠে এসেছিল ডাঙায়

আমি আমগাছ তলায় দুটো কই মাছ ধরেছিলাম

তোমার মনে আছে, মা?

মনে আছে, আলি সাহেবের বাগানের সেই নারকোল

চুরি করে আনিনি, মাটিতে পড়েছিল, কেউ দেখেনি

নারকোল বড়ার সেই স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে।

আলি সাহেবের ভাই মিজান আমাকে খুব আদর করত

বাবা একদিন দেখতে পেয়ে চ্যালাকাঠ দিয়ে পিটিয়েছিল আমাকে

আমার কী দোষ, কেউ আদর করলে আমি না বলতে পারি?

আমার পিঠে এখনও সেই দাগ আছে

আলি সাহেবদের বাগানে আর কোনওদিন যাইনি

আমি আর কোনও বাগানে যাই না।

সেই দাগটায় হাত বুলিয়ে বাবার কথা মনে পড়ে

বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়

আমি ভালো আছি, খুব ভালো আছি

বাবা যেন আমার জন্য একটুও না ভাবে

তুলি কি এখনও ভূতের ভয় পায়?

তুলি আর আমি পুকুর ধারে কলাবউ দেখেছিলাম

সেই থেকে তুলির ফিটের ব্যারাম শুরু হল

দাদা সেই কলাগাছটা কেটে ফেলল

আমি কিন্তু ভয় পাইনি, তুলিকে কত ক্ষেপিয়েছি

আমার আবার মাঝরাত্রে সেই কলাবউ দেখতে ইচ্ছে করে

হ্যাঁ, ভালো কথা, দাদা কোনও কাজ পেয়েছে?

নকুড়বাবু যে বলেছিল বহরমপুরে নিয়ে যাবে

দাদাকে বলো, ওর ওপর আমি রাগ করিনি

রাগ পুষে রাখলে মানুষের বড় কষ্ট

আমার শরীরে আর দাগ নেই, আমি আর এক ফোঁটাও কাঁদি না

মা, আমি রোজ দোকানের খাবার খাই

হোটেল থেকে দু’ বেলা আমার খাবার এনে দেয়

মাংস মুখে দিই আর তুলির কথা, কালু-ভুলুর কথা মনে পড়ে

তোমাদের গ্রামে পটল পাওয়া যায় না

আমি আলু পটলের তরকারি খাই, পটল ভাজাও খাই

হোটেলে কিন্তু কক্ষনও শাক রান্না হয় না

পুকুর পাড় থেকে তুলি আর আমি তুলে আনতাম কলমি শাক

কী ভালো, কী ভালো, বিনা পয়সায়

কোনওদিন আর কলমি শাক আমার ভাগ্যে জুটবে না

জোর হাওয়া দিলে তালগাছের পাতা সরসর করে

ঠিক বৃষ্টির মতন শব্দ হয়

এই ভাদ্দর মাসে তাল পাকে, ঢিপ ঢিপ করে তাল পড়ে

বাড়ির তালগাছ দুটো আছে তো?

কালু তালের বড়া বড় ভালোবাসে, একদিন বানিয়ে দিয়ো

তেলের খুব দাম জানি, তবু একদিন দিয়ো

আমাকে বিক্রি করে দিয়ে ছ’ হাজার টাকা পেয়েছিলে

তা দিয়ে একটা গোরু কেনা হয়েছে তো?

সেই গোরুটা ভালো দুধ দেয়?

আমার মতন মেয়ের চেয়ে গোরুও অনেক ভালো

গোরুর দুধ বিক্রি করে সংসারের সুসার হয়

গোরুর বাছুর হয়, তাতেও কত আনন্দ হয়

বাড়িতে কন্যা সন্তান থাকলে কত জ্বালা

দু’ বেলা ভাত দাও রে, শাড়ি দাও রে, বিয়ের জোগাড় করো রে

হাবলু, মিজান, শ্রীধরদের থাবা থেকে মেয়েকে বাঁচাও রে

আমি কি বুঝি না, সব বুঝি

কেন আমায় বিক্রি করে দিলে, তাও তো বুঝি

সেই জন্যই তো আমার কোনও রাগ নেই, অভিমান নেই

আমি তো ভালোই আছি, খেয়ে পরে আছি

তোমরা ওই টাকায় বাড়ি ঘর সারিয়ে নিয়ো ঠিকঠিক

কালু-ভুলুকে ইস্কুলে পাঠিয়ো

তুলিকে ব্ৰজেন ডাক্তারের ওষুধ খাইয়ো

তুমি একটা শাড়ি কিনো, বাবার জন্য একটা ধুতি

দাদার একটা ঘড়ির শখ, তা কি ও টাকায় কুলোবে?

আমি কিছু টাকা জমিয়েছি, সোনার দুল গড়িয়েছি

একদিন কী হল জানো, মা

আকাশে খুব মেঘ জমেছিল, দিনের বেলা ঘুরঘুট্টি অন্ধকার

মনটা হঠাৎ কেমন কেমন করে উঠল

দুপুরবেলা চুপি চুপি বেরিয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম

স্টেশনে নেমে দেখি একটা মাত্র সাইকেল রিকশা

খুব ইচ্ছে হল, একবার বাড়িটা দেখে আসি

রথতলার মোড়ে আসতেই কারা যেন চেঁচিয়ে উঠল

কে যায়, কে যায়?

দেখি যে হাবুল-শ্রীধরদের সঙ্গে তাস খেলছে দাদা

আমাকে বলল, হারামজাদি, কেন ফিরে এসেছিস?

আমি ভয় পেয়ে বললাম, ফিরে আসিনি গো, থাকতেও আসিনি

একবার শুধু দেখতে এসেছি

হাবুল বলল, এটা একটা বেবুশ্যে মাগি

কী করে জানল বলো তো, তা কি আমার গায়ে লেখা আছে?

আর একটা ছেলে, চিনি না, বলল, ছি ছি ছি, গাঁয়ের বদনাম

হাবলু রিকশাঅলাকে চোখ রাঙিয়ে বলল, ফিরে যা

আমি বললাম, দাদা, আমি মায়ের জন্য ক’টা টাকা এনেছি

আর তুলির জন্য…

দাদা টেনে এক চড় কষাল আমার গালে

আমাকে বিক্রির টাকা হক্কের টাকা

আর আমার রোজগারের টাকা নোংরা টাকা

দাদা সেই পাপের টাকা ছোঁবে না, ছিনিয়ে নিল শ্রীধর

আমাকে ওরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল

আমি তবু দাদার ওপর রাগ করিনি

দাদা তো ঠিকই করেছে, আমি তো আর দাদার বোন নই

তোমার মেয়ে নই, তুলির দিদি নই

আমার টাকা নিলে তোমাদের সংসারের অকল্যাণ হবে

না, না, আমি চাই তোমরা সবাই ভালো থাকো

গোরুটা ভালো থাকুক, তালগাছ দুটো ভালো থাকুক

পুকুরে মাছ হোক, খেতে ধান হোক, ঝিঙে মাচায় ফুল ফুটুক

আর কোনওদিন ওই গ্রাম অপবিত্র করতে যাব না

আমি খাট-বিছানায় শুই, নীল রঙের মশারি

দোরগোড়ায় পাপোশ আছে, দেওয়ালে মা দুর্গার ছবি

আলমারি ভর্তি কাচের গেলাস

বনবন করে পাখা ঘোরে। সাবান মেখে রোজ চান করি

এখানকার কুকুরগুলো সারা রাত ঘেউ ঘেউ করে

তা হলেই বুঝছ, কেমন আরামে আছি আমি

আমি আর তোমার মেয়ে নই, তবু তুমি আমার মা

তোমার আরও ছেলেমেয়ে আছে, আমি আর মা পাব কোথায়?

সেই জন্যই তোমাকে চিঠি লিখছি, মা

তোমার কাছে একটা খুব অনুরোধ আছে

তুলিকে একটু যত্ন করো, ও বেচারি বড় দুর্বল

যতই অভাব হোক, তবু তুলিকে তোমরা…

তোমার পায়ে পড়ি মা, তুমি বাবাকে বুঝিয়ে বলো

তুলিকেও যেন আমার মতন আরামের জীবনে না পাঠায়

যেমন করে হোক, তুলির একটা বিয়ে দিয়ো

ওর একটা নিজস্ব ঘর সংসার, একজন নিজের মানুষ

আর যদি কোনওরকমেই ওর বিয়ে দিতে না পারো

ওকে বলো, গলায় দড়ি দিয়ে মরতে

মরলেও ও বেঁচে যাবে!

না, না, না, এ কী অলুক্ষণে কথা বলছি আমি

তুলি বেঁচে থাকুক, আর সবাই বেঁচে থাকুক

তুলির বিয়ে যদি না হয় না হোক

হে ভগবান, গরিবের বাড়ির মেয়ে কি বিয়ে না হলে বাঁচতে পারে না?

বিয়ে না হলেই তাকে গ্রামের সবাই ঠোকরাবে?

দু’ পায়ে জোর হলে তুলি কোথাও চলে যাক

মাঠ পেরিয়ে, জলা পেরিয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে

আরও দূরে, আরও দূরে, যেদিকে দু’ চোখ যায়

এমন জায়গা নিশ্চয়ই কোথাও আছে, কোথাও না কোথাও আছে

যেখানে মানুষরা সবাই মানুষের মতন

আঁচড়ে দেয় না, কামড়ে দেয় না, গায়ে ছ্যাঁকা দেয় না, লাথি মারে না

যেখানে একটা মেয়ে, শুধু মেয়ে নয়, মানুষের মতো বাঁচতে পারে

মা, তুমি আমার মা, আমি হারিয়ে গেছি

তুলিকে তুমি… তুলি যেন… আমার মতন না হয়!

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন। (কবিকল্পলতায় প্রকাশিত আবৃত্তি ইউটিউব ভিউজ ও সাবস্ক্রাইবার বাড়াতে সহায়তা করে)