Jonmodin Kobita By Subho Das Gupta : জন্মদিন কবিতা – শুভ দাশগুপ্ত

+ প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন +

Kobita, Jonmodin written By Subho Das Gupta

 

আজ পয়লা শ্রাবণ।

খোকন, আজ তোর জন্মদিন।

তুই যখন জন্মেছিলি, আমরা তখন যাদবপুরে

নতুন গড়ে ওঠা কলোনীর টালির ঘরে

তোর ইস্কুল মাস্টার বাবা

সেই হ্যারিকেনের আলো জ্বলা ঘরেই

আনন্দে আর খুশিতে ঝলমলে হয়ে উঠেছিলেন

তুই আসার পর। তোর নাম রেখেছিলেন- সুকল্যাণ।

মানুষটার মনটা ছিল শিশুর মতন

অভাবে অনটনে, বেঁচে থাকার নানা দুর্বিপাকেও

ভেঙ্গে পড়তেন না কখনও। সকলের ভাল চাইতেন মন থেকে।

বলতেন দেখো একদিন এই দেশের মানুষ

ঠিক খুঁজে পাবে মুক্তির পথ। শোষণ থেকে মুক্তি

দারিদ্র থেকে মুক্তি অশিক্ষা থেকে মুক্তি…

আজ পয়লা শ্রাবণ

খোকন, আজ তোর জন্মদিন।

ছোটবেলায়, তোর মনে আছে? আমাদের ভাঙ্গা মেঝেতে

বাক্স থেকে বার করা মেজো-মাসীর হাতে তৈরি আসনটা

পেতে দিতাম। সামনে রাখতাম ঠাকুরের আসনের প্রদীপখানা।

তুই বসতিস বাবু হয়ে চুপটি করে।

তোকে আমরা একে একে ধান দুব্বো মাথায় দিয়ে আশীর্বাদ করতাম।

বাবা বলতেন বড় হও মানুষ হও।

তোর বাবার সেই বন্ধু-ঘোষ কাকা তিনি বলতেন

বেঁচে বর্তে থাকো।

তুই জিগ্যেস করতিস-মা, বর্তে মানে কি মা?

আমি শুধু তোর মাথায় ধান-দুব্বোই দিতাম।

বলতাম না কিছুই। শুধু মনে মনে বলতাম

ঠাকুর, আমার খোকনকে মস্ত বড় মানুষ করে তোলো

আমার খোকন যেন সত্যিই মানুষ হয়।

ওর যেন কখনো কোনো বিপদ না হয় ঠাকুর।

অভাবের সংসারে ওই একটা দিন-পয়লা শ্রাবণ

কষ্টের পয়সায় একটু বাড়তি দুধ নিতাম।

পায়েস রান্না করে দিতাম তোকে।

তুই খুব ভালবাসতিস পায়েস খেতে।

তোর বাবা বাসস্টান্ডের দোকান থেকে নিয়ে আসতেন

তোর প্রিয় মিষ্টি ছানার গজা।

সামান্য ইস্কুল মাস্টারিতে কীই বা আয় হত;

ঘরে বসে ছাত্র পড়িয়ে আসতো কিছু।

দাউ দাউ অভাবের আগুনে সে রসদ পুড়তে সময় লাগত না।

তোর বাবার জামা সেলাই করতাম আর বার বার বলতাম

আসছে মাসে একটা জামা বানিয়ে নিও।

উনি হেসে উঠে বলতেন; বাদ দাও তো, খোকন বড় হচ্ছে।

ওর জন্য ভাবছি দুধ রাখতে হবে আরো আধসের-

দুধে শক্তি বাড়ে। বুদ্ধি বাড়ে। শক্তি আরে বুদ্ধি না হলে

তোমার খোকন মস্ত বড় মানুষ হয়ে উঠবে কি করে?

ভাবছি আরো দুটো টিউশনি নেব।

ছাত্র পড়িয়ে পড়িয়ে মানুষটা দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে যেতেন।

বারান্দার ধার ঘেঁষে যখন রাতের অন্ধকারে জোনাকির ব্যস্ততা,

আর ঘরে তোর পড়া মুখস্থ করার একটানা সুর

আমাদের কলোনীর ভাঙ্গাচূড়া বাড়িটাকে জীবন্ত করে রাখতো-

তখন বলতেন আমায়; খাওয়া দাওয়া একটু করো- তোমার চেহারাটা

বড় ভেঙ্গে পড়ছে দিন দিন… শাড়িটাও তো দেখছি বেশ ছিঁড়েছে-

কালই আমি ফেরার পথে একটা শাড়ি নিয়ে আসব। ধারেই আনব।

আমি বলতাম-ধুর। সামনে খোকনের উঁচু ক্লাস-

কত বই পত্তর কিনতে হবে- কত খরচ।

উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যেতেন।

জোনাকিরা নিঃশব্দ অদৃশ্য আলোর আলপনা আঁকত

উঠনের আগাছার ঝোপে।

আবহ সঙ্গীতের মত তুই ভেতরে বসে বসে পড়া মুখস্থ করতিস।

ইতিহাস, ভূগোল, গ্রামার।

ঈশ্বর আমাদের নিরাশ করেননি।

তুই কত বড় হলি।

সব পরীক্ষায় কত ভাল ফল হল তোর।

বাবা বললেন; আরও পড়। উচ্চ শিখাই উচ্চ সম্মানের

এক মাত্র পথ। তুই আরও পড়লি।

তারপর…

তোর চাকরি হল কত বড় অফিসে

মনে আছে খোকা? প্রথম মাসের মাইনে হাতে পেয়েই

তুই কত কী কিনে এনেছিলি?

তখন তো আমরা উঠে এসেছি শ্যামবাজারে।

দু’কামরার বেশ সাজানো ঘোচানো গোছানো বড় ফ্লাট।

তোর অফিস থেকেই তো দিয়েছিল।

সেই বাড়ি সেই ঘর সেই বেলকনি- কত স্মৃতি- কত ছবি!

ঐ বাড়িতেই তো

আশ্বিনের ঝড়ো বিকেলে- তোর মনে আছে খোকন?

তোর বাবা যেদিনটাতে চলে গেলেন- মনে আছে?

তুই বাবার বুকের ওপর পড়ে যখন কাঁদছিলি হাপুস নয়নে

সদ্য স্বামীহারা, আমি সেদিন তোর সেই অসহায় মুখ দেখে

আরো বেশি করে ভেঙ্গে পড়েছিলাম।

তোকে বুকে টেনে নিয়েছিলাম ছোটবেলার মত।

বলেছিলাম-

কাঁদিস না খোকা। আমিতো আছি।

আজ পয়লা শ্রাবণ

কলকাতা থেকে অনেক দুরে মফস্বলের এই বৃদ্ধাশ্রমে

আমি একেবারে একা, খোকন।

তোকে বড় দেখতে ইচ্ছে করছে রে।

তোকে, বৌমাকে আর ছোট্ট বিল্টুকে।

তোরা এখন কত দুরে-

সল্ট-লেকের মার্বেল বসানো ঝকঝকে বাড়িতে।

আজ তোর জন্মদিনের নিশ্চয়ই খুব বড় পার্টি হচ্ছে-

তাই নারে খোকন? লোকজন, হৈচৈ, খাওয়া-দাওয়া।

খুব ভাল, খুব ভাল।

খোকন, আজ পয়লা শ্রাবণ

আমার বড় মনে পড়ছে যাদবপুরের ভাঙ্গা ঘরে রাত্রে

তুই আমার পাশে শুয়ে মাঝে মধ্যে হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে

জড়িয়ে ধরতিস আমাকে। আমি বলতাম, ভয় কী রে?

আমি তো আছি। মা তো আছে খোকনের। যার মা থাকে

তাকে কী ভুতে ধরে?

তুই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তিস আমার বুক জুড়ে।

তোর আধুনিক সংসারে

এই বুড়িটার একটু ঠাই হল নারে?

প্রতিমাও তো মা। ওরও তো আছে আমার খোকনেরই মত

কোল আলো- করা এক চাঁদের টুকরো।

কিন্তু সময়ের কী আশ্চর্য পরিবর্তন!

খোকন!

তুই বোধহয় আর এখন পায়েস খাস না- তাই নারে?

তুই জানিস না খোকন

আজ আমি সকালে পায়েস রান্না করেছি। হ্যাঁ

তোরই পাঠানো টাকায়।

সারাদিন সেই পায়েসের বাটি সামনে নিয়ে বসে আছি রে।

এখানে এই বৃদ্ধাশ্রমে

আমার একলা ঘরে

আর কেউ নেই।

তুই একবার আসবি খোকন।

একবার.. শুধু

একবার।।

One comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন। (কবিকল্পলতায় প্রকাশিত আবৃত্তি ইউটিউব ভিউজ ও সাবস্ক্রাইবার বাড়াতে সহায়তা করে)