অর্কেস্ট্রা (নিবে গেল দীপাবলী; অকস্মাৎ অস্ফুট গুঞ্জন) – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

শ্রীযুক্ত অপূর্বকুমার চন্দ বন্ধুবরেষু—

 

নিবে গেল দীপাবলী; অকস্মাৎ অস্ফুট গুঞ্জন

স্তব্ধ হল প্রেক্ষাগারে। অপনীত প্রচ্ছদের তলে,

বাদ্যসমবায় হতে, আরম্ভিল নিঃসঙ্গ বাঁশরী

নম্র কণ্ঠে মরমী আহ্বান; জাগিল বিনম্র সুরে

কম্পিত উত্তর বেহালায় অচিরাৎ। মোর পাশে

সমাসক্ত নাগর-নাগরী সঙ্গে সঙ্গে বিকর্ষিল

ছিন্নগুণ ধনুকের মতো; গাঢ়হাস্য প্রণয়ের

একান্ত প্রলাপ লজ্জা পেল সাধারণ্যে। আচম্বিতে

সচেতন প্রতিবেশিনীর ক্ষৌম কেশে উচ্চকিত

রতি পরিমল, পরদেশী সংগীতের ঐকতান

সমর্থনে যেন, পুনরায় উদ্বুদ্ধ করিল চিত্তে

অতিক্রান্ত উৎসবের বিক্ষুব্ধ ও বিক্ষিপ্ত সম্মোহ।।

 

*

 

অস্তাচলে চন্দ্র দিশাহারা;

অতন্দ্রিত জোনাকি ম্রিয়মাণ;

বিদায় মাগে মলিন শুকতারা;

স্বপনলীলা হয়েছে অবসান॥

 

ত্রিযামা রাতি চাহিয়া বৃথা যারে,

জাগিল ধরা বিজন ফুলশেজে,

ছিন্ন ফুল, শুষ্ক সহকারে

উঠে কি তারই পদধ্বনি বেজে?

 

সে আসে ওই, সে আসে ওই দূরে,

উতল বায়ু অধীরে কহে কানে;

স্তম্ভসম তরুর চূড়ে চুড়ে

প্রহরী পাখী মুখর হল গানে।।

 

*

 

রাত্রিশেষের দ্বিধাদুর্বল আলো

উঁকি মারে ওই খোলা জানালার ধারে;

নির্বাণ দীপে ধূমকজ্জল কালো

মূর্ত করেছে ব্যর্থ প্রতীক্ষারে।।

 

বিশ্বজগৎ হিম কুয়াশায় ঘেরা;

দীর্ঘশ্বাসে বিষায়িত মোর গেহ;

রবি, শশী, তারা—সর্ববল্লভেরা,

সকলে উধাও; দূরে, কাছে নেই কেহ।।

 

কে জানে কোথায় আজিকে সে পলাতকা,

সে-মায়ামৃগীরে কের ধরেছে, ফাঁদ পাতি?

মৃত্যু, কেবল মৃত্যুই ধ্রুব সখা,

যাতনা, শুধুই যাতনা সুচির সাথী।।

 

চিন্তাও আর আগায়ে যেতে না পারে;

গতাসু হতাশ; বিলাপ চেতনাহত।

সহসা বিমুখ বাতাসে বন্ধ দ্বারে

কার করাঘাত বাজে স্বপনের মতো?

 

 

ফুকারিল রণতূর্য; প্রতিধ্বনি প্রভব দুন্দুভি

সাড়া দিল সমস্বরে; চমৎকৃত সুষিরে সুষিরে

ভরিল বিপুল মন্ত্র; তন্ত্রে তন্ত্রে হল বিনিময়

গমক, মূর্ছনা, মীড়; লক্ষ লক্ষ অদৃশ্য কিঙ্কিণী

অধীর আগ্রহ-ভরে বিতরিল দিকে দিগন্তরে

স্বর্ণপ্রভ কবোষ্ণ ঝংকার। তরুণীর বভ্রু কেশে

সঞ্চরিল শিহরণ বিচঞ্চল করতাল থেকে।।

 

*

 

সপ্ততুরগ রবি আগত সহসা উদয়শৈলশিখরান্তে :

শাপবিমোচিত বসুধা বন্দে তারণ চরণোপান্তে।

মলয় কমলরজ বরষে; মধুকর মুখরে হরষে;

মায়ামুকুরিত সরসে ছায়া নিরখে কান্তে।

সপ্ততুরগ রবি আগত সহসা উদয়শৈলশিখরান্তে।।

 

আগত, আগত উদার সবিতা : প্রাচী রঞ্জিত রাগে;

উত্তর-দক্ষিণ-অস্তদিগন্তে লাগে আশিস্ লাগে।

চিরপরিচিত গৃহশিখরে কুহককনককণ ঠিকরে;

ধূলিমলিন পুরশিকড়ে জাগে শিহরণ জাগে।

আগত, আগত উদার সবিতা : প্রাচী রঞ্জিত রাগে।।

 

*

 

ললাট তোমার দিনের আশিসে দীপ্র;

নয়নে তোমার অমর প্রাণের লাস্য;

নিঃশ্বাস তব প্রণব আবেগে ক্ষিপ্ৰ;

তুমি প্রসন্ন অধরার স্মিত হাস্য।।

 

কুন্তলে তব শরৎসাঁঝের ঋদ্ধি;

পাকা দ্রাক্ষার মদির কান্তি অঙ্গে;

উরসে তোমার মর সাধনার সিদ্ধি;

ধরা রূপবতী, সে তোমারই অনুষঙ্গে।।

 

কত জনমের বঞ্চনাব্যথা মত্ত

পেয়েছে তোমার তিনটি কথায় ক্ষান্তি।

অলীক স্বপন—তুমিই নিপট সত্য;

চলচঞ্চলা—তুমিই পরম শান্তি।।

 

 

নীরব সকল যন্ত্র; ক্লান্তিহীন বেহালা কেবল

ফিরিল সপ্তকরথে সমধর্মী সৃহৎ-সন্ধানে

গ্রাম হতে গ্রামান্তরে। টুটিল হঠাৎ সনির্বন্ধ

অনুনয়ে তার শরমের সংকোচন নির্বচন

পিয়ানোর বুকে; সঞ্চালিত কড়ি ও কোমলে দ্রব

সুর উদ্বেল, উচ্ছল হল; অতিমর্ত্য অনুনাদে

ভ’রে গেল সংগীতের শূন্য অবকাশ। মোর পাশে

মৌণ বিদেশিনী অহৈতুক সোহাগের আকস্মিক,

গূঢ় প্রবর্তনে স্থাপিল অধীর পাণি দয়িতের

চমৎকৃত ভুজে, চিত্রল, নখের মূলে শশিকলা

করি বিকিরণ। পরশিল আমারে উত্তরী তার।।

 

*

 

দখিন বায়ু আসি নির্ঝরিণীকানে

ভনিল কোন্ কথা, তা শুধু সেই জানে।

সহসা সে-সুমনা হয়েছে বিবসনা,

অশীল নটীপনা জেগেছে প্রাণে প্রাণে।

কহিল সমীরণ কী কথা কানে কানে?

 

অচল শিলা-বুকে উন্মাদিনী নাচে;

স্ফুরিত তনুলতা, বুঝি না, কারে যাচে।

মেখলা, কটিতটে, চমকে ছায়ানটে;

নূপুরে জাদু রটে; করবী উড়ে পাছে।

স্তব্ধ মেঘে যেন সৌদামিনী নাচে!

 

সে যেন মায়ামৃগী, বিতরি কস্তুরী,

পাগল বায়ু-সনে খেলিছে লুকাচুরি!

কখনও বনছায়া ঢাকে সে-বরকায়া;

কভু সে-পীত মায়া আলোরই কারিগুরি।

অপ্সরীতে প্যানে খেলে কি লুকাচুরি?

 

*

 

ছায়াবীথি মোহে ঢাকা,

সোনা-খচা পথখানি,

ফুলে অবনত শাখা

গুঞ্জরে বনবাণী।।

 

জানি আছ সে-রহসে,

তবু খুঁজি দিশাহারা—

অগোচর তামরসে

অলি বুঝি মাতোয়ারা।।

 

নাতিদূরে তব হাসি

উন্মুথে নীরবতা,

কঙ্কণ কলভাষী,

বলে, শুনি, উপকথা!

 

হে তপতী, তোমা চুমি,

বায়ু আজি হিমজয়ী!

দিবে না কি ধরা তুমি,

ওগো কৌতুকময়ী?

অবশেষে দাও দেখা,

বুকে লাইলাক্-রাশি;

মুখে রঙ্গিলা রেখা,

ছুটে চলো পাশাপাশি।।

 

অচিরাৎ ছল ভুলি,

ফিরে চাও আনমনে;

পথপাশে ফুলগুলি

ঝ’রে পড়ে অযতনে।।

 

গূঢ় অশ্রুতে যেন

অকারণে দ্রবীভূত,

হাতে হাত রেখে, কেন

করো মোরে অভিভূত?

 

তার পরে ভাবাবেশে

সংকোচ বিস্মরি,

অধরার উদ্দেশে

পা বাড়াও, সহচরী॥

 

ডাকে বন সমুখে যে,

ঘরতর হয় ছায়া!

সেখানে কি ফুলশেজে

মিশে যাবে দুটি কায়া?

 

 

আবার সকল তুরী, সমস্ত বিষাণ আরম্ভিল

সমস্বরে কাংস্য কোলাহল; অভ্রভেদী রুদ্রবীণা

ঝংকারিল সমুচ্চ সপ্তমে; মহীয়ান্ অর্গানের

সাগরসংগীতে পিয়ানোর স্নিগ্ধ কণ্ঠ ডুবে গেল

ক্ষীণতোয়া তটিনীর মতো। ত্রিভুরণ পরিপ্লুত

হল তানে, তালে, সুরসমন্বয়ে; রহিল না কোনও

ছিদ্র, নিবৃত্তি, বিরাম। রঙ্গমঞ্চ হতে পলাতক

আলোকের স্পন্দিত অগ্নিমা বিচ্ছুরিল অকস্মাৎ

পার্শ্ববর্তী যুবতীর নীলাঞ্জন নয়নের কোণে॥

 

*

 

অগাধ গগন হতে, দ্বিপ্রহরে,

আলোর সোনালী সুরা অঝোরে ঝরে;

সে-মাতনে বাহু তুলে, অটবী দোদুল দুলে;

তারই কণা ফুলে ফুলে উঠেছে ভ’রে।

ঝরে আলোকের সুরা দ্বিপ্রহরে।।

 

অসীম নীলিমা হাসে উদার নভে;

পুলকিত শ্যামলিমা অখিল ভবে।

ছায়াতে কি প্রয়োজন? সংকোচ অশোভন

মিলনের বিবসন মহোৎসবে।

ধরণীতে শ্যামলিমা, নীলিমা নভে।।

 

কখন হয়েছে মূক পাখীর গীতা;

অকপট সমারোহে বচন বৃথা!

শোনো মৌনের তলে বিধাতা অবাধে চলে,

আঁকিয়া অলখ হলে প্রাণের সীতা!

অকপট সমারোহে বচন বৃথা।।

 

*

 

হিরণ নদীর বিজন উপকূলে

আচম্বিতে পথের অবসান;

তপোবনে কল্পতরুর মূলে

আবির্ভূত নিত্য বর্তমান।।

 

পরপারে নাম-না-জানা গ্রাম

রৌদ্রে রঙীন মরীচিকার প্রায়,

পশ্চাতে মাঠ উধাও, ঘনশ্যাম,

লুটায় গিয়ে স্বর্গলোকের পায়।।

 

সাত সমুদ্র পেরিয়ে, চারণ বায়ু

অচিন ভাষায় করছে কথকতা;

ঝংকারে তার মুখর মোদের স্নায়ু,

জিহ্বা অবাক, নয়ন বলে কথা।।

 

থামল প্রলাপ স্রোতস্বিনীর মুখে;

স্তব্ধ হল হাওয়ার কোলাহল;

শুনতে পেলেম আপন নীরব বুকে

আহুতি চায় অজর হোমানল॥

 

পড়ল তোমার ব্যাকুল বসন টুটে,

বিশ্বম্ভর চরণপ্রান্ত চুমি;

ফিরল পুলক রিক্তাকাশে ছুটে।

কল্পলোকের উর্বশী কি তুমি?

 

শূন্যে হঠাৎ লুপ্ত বসুন্ধরা;

ত্রিভুবনে কেবল তুমি-আমি :

সৃজনপ্রাতের প্রথম যমক মোরা,

প্রলয়রাতের শেষ বনিতা-স্বামী।।

 

 

সহসা ডম্বরু, ডঙ্কা বজ্রকণ্ঠে উঠিল হুংকারি;

ক্ষণে ক্ষণে কর্কশ ঝঞ্ঝনা ঝংকারিল করতালে

বিপরীত সুরে; রহি রহি নিবদ্ধ তন্ত্রের ’পরে

বিচরিল অসংগত সুরের ঝলক; তীব্র বাঁশি,

বিদীর্ণ কীচক-সম, প্রচারিল প্রলয়ের ক্ষতি

অরুন্তুদ হাহাকারে; অর্গানের সান্তর গর্জনে

বাসুকির নাভিশ্বাস শ্রুতিগম্য হল অচিরাৎ;

পিয়ানোর ক্ষিপ্ত আস্ফালনে উচ্চারিল মূর্ত মৃত্যু

নৃশংস নির্দেশ। সে-বিক্ষুব্ধ উতরোলে কিশোরীর

উদ্দীপ্ত নয়ন নিবে গেল আচম্বিতে; নিরুৎসুক,

শ্লথ, স্তব্ধ তনুলতা তার অকস্মাৎ মোর রিক্ত

বুকে করিল সঞ্চার বিষাদের উদাস বেদনা।।

 

*

 

আজি ফাগুনবেলার পরসাদ

যায় হারায়ে অকাল বালে,

ভাঙে সুখশান্তির অবসাদ

ওই মত্ত মেঘের মাদলে।

ফুঁকে কালবৈশাখী তূর্য;

কাঁপে দেওদার, বট, ভূর্জ;

ডুবে মধ্যদিনের সূর্য

ভীমা অমাবস্যার আদলে।

টুটে সিদ্ধ কামের পরমাদ

আজি সহসা অকাল বাদলে।।

 

ঘোর ঈশানে সঘনে গরজায়

ওই প্রলয়পাগল অশনি;

ভাঙা কুঞ্জবনের দরজায়

নাচে রুদ্রাণী দিগ্‌ বসনী;

তারই লেলিহান অসি খরধার

লিখে গগনে গগনে সংহার;

যত ত্রিকালতিষ্ঠ মূলাধার

পাড়ে ঝঞ্ঝা বরাহদশনী।

ধরা আঘাতে আঘাতে মূরছায়;

ক্রোধে গরজে গগনে অশনি

আজ মহেশ মেলেছে বিলোচন,

পায়ে তাণ্ডব জেগে উঠেছে;

হল বিন্ধ্যের শাপবিমোচন,

পুন সৌরলোকে সে ছুটেছে।

বুঝি উদ্‌ঘাট দ্বার নরকের;

যত তৃষিত পিশাচ মড়কের,

তারা মেতেছে গাজনে চড়কের;

সারা বিশ্বের স্থিতি টুটেছে।

ওই রসাতলে যায় ত্রিভুবন;

আজ প্রলয়েশ জেগে উঠেছে।।

 

*

 

খেলাচ্ছলে শুধিয়েছিলেম, “তোমার প্রেমে

নই কি আমি প্রথম আগন্তুক।”

অবাক বিষাদ এল তোমার চক্ষে নেমে;

রক্তে ভাঁটা, ফিরিয়ে নিলে মুখ।।

 

বলতে গিয়ে, আটকে গেল আত্মকথা;

করুণ কাঁপন লাগল ওষ্ঠাধরে;

আচম্বিতে সংকুচিত তনুলতা,

লুকাল না লজ্জা দিগম্বরে।।

 

যোগ হারাল হঠাৎ নিবিড় আলিঙ্গনে,

শূন্য ঘিরে রইল আমার বাহু;

নাড়লে মাথা, কাঁটায় কাঁটা গোলাপবনে

গর্বেরে মোর করলে কি গ্রাস রাহু?

 

লুপ্ত হল আধারবিন্দু বিশ্ব হতে;

খিল খসাল নাস্তি পুনর্বার;

ভাগ্যরবি চলল ছুটে পাতালপথে;

চতুর্দিকে আদিম অন্ধকার।।

 

একলা আমি ধ্বংসাবশেষ কালের ‘পরে;

সামনে মরু অস্থিসমাকুল।

মৃত্যু স্বয়ং বিস্মরিল আজকে মোরে;

অস্তমিত বিধির আমি ভুল।।

 

 

ক্ষণকাল নিস্তব্ধ সকলই। তার পর আর বার

মোহন মুরলী কী অপূর্ব পূরবীর মোহময়

সুরের আবেশে তুলিল রণিত করি সীমাশূন্য

শূন্যতার হিয়া; সারেঙ্গীর রলরোল বিলম্বিত

তালে সমাচ্ছন্ন পিয়ানোর মুখে সিঞ্চিল পরম

যত্নে সঞ্জীবনী সুধা; অলক্ষ্য কিঙ্কিণী ঝংকারিল

শান্ত সুরে বিরামে বিরামে। কান্তের বিহ্বল স্পর্শ

ফিরে দিল উৎসুক কম্পন যুবতীর জড় দেহে।।

 

*

 

সন্ধ্যার রাগ ছিন্ন মেঘের অন্তরে

অঙ্গারমসি প্রেমালোকে করে পুণ্য;

পূর্ব গগনে মধুনিশা আসে মন্থরে,

প্রতিচ্ছায়ায় রঙীন উদাস শূন্য।।

 

পরপারে, কোথা অনামা গ্রামের কির্মীরে,

দৈববাণীর ছন্দে মুখরে ঘন্টা;

এ-পারে, সুচির ধ্রুবতারকার মির্মিরে,

স্নাত উপবন পাসরিল উৎকণ্ঠা।।

 

দূর দিগন্তে, নিবাত ধূমের ডম্বরে

বাজে পলাতক ঝড়ের মুরজমন্ত্র;

গত দুর্যোগ—সে যেন ঊষার অম্বরে

বিরহরাতের দুঃস্বপনের চন্দ্র!

 

অমৃতলোকের কৌতুকে কাঁপে ক্রন্দসী;

পরিমণ্ডলে বাহিত অলকানন্দা;

ঝিল্লীর ডাকে মরধামে নামে ঊর্বশী;

তিমিরতোরণে ফুটেছে রজনীগন্ধা।।

 

অভয় নিশার দক্ষিণ হাতে উদ্ধৃত,

সপ্ত প্রদীপ ধ্রিয়মাণ বাম হস্তে;

যদিও দিনের ভাস্বর আঁখি মুদ্রিত,

মর্ত্যমহিমা যায় নাই তবু অস্তে॥

 

*

 

স্বর্ণভারে তোমার মাথা লুটিছে মম ঊরুতে;

নিবিড় নীল নয়ন-কোণে সজল স্মৃতি অঙ্কিত;

অতীত ব্যথা—কেবল তার ত্রিবলি তব ভুরুতে;

হরিণীসম, কম্প্র তনু অহেতু ভয়ে শঙ্কিত॥

 

কণ্ঠে মম জড়ায়ে আছে তোমার ভুজমালিকা;

বচনাতীত প্রলাপ তব শ্রবণে মম গুঞ্জরে।

কী মায়াবলে ঊর্ণাজালে বেঁধেছ, সুরবালিকা,

মদস্রাবী, ঈর্ষাপর, সর্বনাশা কুঞ্জরে?

 

স্পর্ধা মোর পড়েছে টুটে, ভ্রান্তি মোর গিয়েছে;

দৃপ্ত শির পঙ্কে লুটে, তোমার চরণাম্বুজে;

নিঃস্ব আমি, বিশ্ব তাই আজিকে কোল দিয়েছে;

রাজার প্রেমকাহিনী যেন ব্যক্ত ভাঙা গম্বুজে!

 

চিনেছি চির মানবী তুমি; পাবন তব করুণা

অযোগ্যের অবগাহনে হয় ম্লান, লাঞ্ছিত;

প্রথম ঠাঁই পাইনি তাই তোমার প্রেমে, অরুণা;

প্রত্যাগত মাধবে আজি তাই কি আমি বাঞ্ছিত?

 

 

উদাত্ত বিষাণ উৎসরিল ঊর্ধ্বগ আহ্বান; মুগ্ধ

বেণু, দীর্ঘায়িত মিনতির সুরসূত্র টানি, বেঁধে

দিল রন্ধ্রে রন্ধ্রে সংযোগের রাখি; আবিষ্ট মূর্ছনা,

উদ্বেল অন্তর হতে, উত্তরিল বেহালার তারে;

ত্রিপথগা সুরধুনী, অর্গানের শঙ্খনাদে জেগে,

চরাচর ডুবাল উর্বর মোক্ষে। অগাধ উল্লাসে

লোকলজ্জা সহসা তলাল; প্রণয়ীর বাহুপাশ

ঘেরিল তন্বীর তনু অপরোক্ষ স্নেহে; চারি চোখে

হয়ে গেল দেওয়া-নেওয়া কী বেদনা অনির্বচনীয়!

 

*

 

স্বর্গের মর্ত্যের সকল ব্যবধান লুপ্ত সনাতন রাত্রে;

মৌনের নির্ঝর মেদুর সুরাসার সিঞ্চে গগনের পাত্রে;

জন্মস্বর কার প্রণব সারিগান স্বপ্নাবেশে পিক গুঞ্জে;

প্রাক্তন পুষ্পের অমর অবদান স্ফূর্ত গোলাপের পুঞ্জে;

চন্দ্রের কৌস্তুভ, উরসে প্রকৃতির, মুগ্ধ নিদ্রায় স্তব্ধ;

মৃত্যুর মঞ্জীর নীরবে শোনা যায়; শূন্যে মিশে যায় অব্দ;

সিদ্ধির নির্বাণ প্লাবিল মরধাম। কাজ কি অমরায় অন্য?

সুপ্তির সন্ধান দিয়েছে ভগবান; ধন্য, ধরা আজ ধন্য!

 

*

 

পূর্ণ চন্দ্র খোলা বাতায়নে পশিছে ঘরে,—

তব তনুলতা সুপ্ত কুসুমশয়ন-স্বপরে।

জ্যোৎস্না তোমার পীড়িত উরোজে

বিথারে প্রলেপ সিত মলয়জে;

স্তিমিত অঙ্গে মন্দারসার বপন করে।

নিদ্রিত সুখশান্তিতে তুমি শয়ন-’পরে।।

 

মায়ামৃগী, তুমি বন্দিনী আজ আমার গেহে,—

আমার অমরা আশ্রিত তব মানুষী স্নেহে।

স্খলিতবসন উরুতে তোমার

অনাদি নিশার শান্তি উদার;

নব দূর্বার চিকন পুষ্পক ও-বরদেহে।

বিশ্বের প্রাণ বিকচ আজিকে আমার গেহে।।

 

মরণের সুধা সঞ্চিত তব আলিঙ্গনে;

জন্মান্তর নিমেষে ফুরায় ও-চুম্বনে;

তোমার নিবিড় নিঃশ্বাসবায়ু

করে হিমায়িত শবেরে শতায়ু

সন্নিধি তব সৃজন-আকূতি-পরানে-ভনে

আসে তথাগতি তোমার প্রগাঢ় আলিঙ্গনে।।

 

খোলা বাতায়নে চন্দ্রমা চুমে তোমার মাথা;

দূর নীহারিকা গুঞ্জে শ্রবণে সুপ্তিগাথা।

তব স্বপনের শমিত লহরী

দেয় মোর বুকে হিন্দোলা ভরি;

গভীর আবেশে নিমীলিয়া আসে চোখের পাতা

বিধির আশিস মুকুটিত করে যুগল মাথা।।

 

অকস্মাৎ স্বপ্ন গেল টুটে। দেখিলাম ত্রস্ত চোখে

জনশূন্য রঙ্গালয়ে নির্বাপিত সমস্ত দেউটি,

নিস্তব্ধ সকল যন্ত্র, মঞ্চ-’পরে যবনিকা ঢাকা।

অলক্ষ্যে কখন পার্শ্ব হতে প্রেমিক-প্রেমিকা চ’লে

গেছে অমৃতসংকেতে। শান্তি—শান্তি—শান্তি চারি ধারে।

কেবল অস্তর মোর উত্তরঙ্গ ক্ষুব্ধ হাহাকারে।।

 

১১ ফেব্রুআরি ১৯৩২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।