উর্বশী ও আর্টেমিস (সন্ধ্যার বর্ণের ছটা রয়েছে তো তবু) – বিষ্ণু দে

প্রিয়জনের কাছে শেয়ার করুন :—

Glory and loveliness have passed away—

 

সন্ধ্যার বর্ণের ছটা রয়েছে তো তবু,

তবু তো আকাশে

ছুটে চলে শব্দময়ী অপ্সররমণী

ঝঞ্ঝামদরসে মত্ত শত বলাকার পক্ষধ্বনি।

পুরূরবা নেই আর—

ক্লান্ত স্থির আকাশের বুকে

দূরগামী সূর্য আজো ঢেলে দেয় তবু

গলন্ত তামার দীপ্ত রক্তিম চুম্বন।

আজো তবু ওরায়ন-প্রিয়া

কুমারীর ক্ষীণ দেহ বয়ে যায় সবুজ আলোতে।

প্রিয়ার শরীর

পুরুষের মনে আজো বোনে নিদ্রাহীন ইন্দ্রজাল।

আজো তাই লাবণ্যের ঘরে

সন্ধ্যার কবিত্বময় কোমল আলোয়

ট্রিস্টান ও ইসোডের রোমাঞ্চনিবিড় সুরে সংগীতমায়ায়

মগ্ন হয়ে বাক্যহীন আমি রই চেয়ে,

আর বয় পাশে

রূপকথা-স্বপ্ন বয়, প্রেমের কবিতা বয়

শ্রাবণের পূর্ণদিঘি লাবণ্যের চোখে।

লাবণ্যের মায়া আজ ধরেছে আমায়

লাবণ্যের মূর্তি আজ ছায়

আমার পৃথিবী, ছায়

সমুদ্র আকাশ

দিনের ধমনীছন্দ রাত্রির নিঃশ্বাস

লাবণ্যের মূর্তি সদা ইহুদির ঈশ্বরের মতো

আমাকে রেখেছে লক্ষ্য, ছাড়ে নাকো মুহূর্ত কখনো।

 

হে স্যর্সি, বেঁধেছ মোরে, আরো বাঁধো,

আমি ভালোবাসি

তোমার সর্পিল কেশ, নিমীলনীলিম তব চোখ

মোর চোখে আসি

রক্তের সুতায় রাঙা সুনিপুণ তোমার অধরে

বেঁধে দিক মুখ

ঊরুবন্ধে বাহুবন্ধে বাধো, স্যর্সি, সে ঘন বন্ধন

রোমাঞ্চে ফুটুক।

 

বিপুল পৃথিবী আর নিরবধি কাল

অর্জুন আসে না আর, চিত্রাঙ্গদা কবে মুছে গেছে

তপোবন নেই আর কণ্ঠমুনির

আজো তবু বিপুল পৃথিবী

আজো এই আমাদের কাল

আজো এই জ্ঞানবিজ্ঞ জরাবৃদ্ধ অভিজ্ঞ ভুবন

পলাতকা উর্বশীর প্রতি পদপাতে

দুলে দুলে ওঠে স্নায়ুআলোড়িত উতলা কম্পনে।

আজো তাই পরিশ্রান্ত ম্যামন-মলিন

জলস্থল কেঁপে ওঠে উর্বশীর দেহের আস্বাদে।

কত রাত্রি, কত বৰ্ষ, কত দীর্ঘ শতাব্দীরা গেল

ক্লিয়োপেট্রা থেকে আজ হয়ে গেল বিংশতির পালা,

আজো তবু উর্বশীর স্তন

উর্বশীর পাণ্ডু ঊরু শুভ্র বাহু উচ্ছৃঙ্খল যৌবনের চোখ

আমাদের করে রাখে তৃপ্তিহীন একাগ্র বৈরাগী।

আজো তবু গোধূলি মলিন

ধোঁয়ায় মলিন এই শব্দখর কুৎসিত নগরে

তন্দ্রালসা সন্ধ্যা নামে নবীন ধরার মায়া

ধরে তার দুই স্নিগ্ধ করে।

 

আজো তাই লাবণ্যের ঘরে

আমার চেতনা ছেয়ে মায়া জাগে লাবণ্যের নিঃশ্বাসের স্বরে

নিঃশ্বাসের গন্ধে তার চুলের কালোয়

উর্বশীর মায়া লাগে লাবণ্যের আঙুলের মৃদুস্পর্শবরে

উর্বশীর মায়া।

লাবণ্যের মুখে আজ বতিচেল্লি এঁকেছে ভিনাস্

ভিনাসের ছায়া

আমার চেতনাঘর স্বপ্নে আজ করেছে রঙিন

আকাঙ্ক্ষার আমার আকাশ করে দিলে নীল শরতের দিন

সূর্যাস্তের দীপ্তিতে রঙিন,

আমাকেও করে দিলে বাসনার আশ্চর্য সিম্‌ফনি।

শতস্বপ্ন-নাইলাসে ভেসে গেল পৃথিবী আমার

নির্নিমেষ অনিদ্রায় ডুবে গেল নিদ্রার আহুতি

মিশে গেল রাত্রি আর দিন।

 

আজ শুধু প্রার্থনা আমার

আর্টেমিস্, প্রার্থনা আমার

হেক্টরের মৃতদেহ রক্তস্নাত রথচক্রক্ষত হল মন

আমাকে পাঠিয়ে দাও, আজ তুমি দিয়ে যাও

দ্রুতগতি তোমার আশ্বাস।

আর্টেমিস্, প্রার্থনা আমার।

চিত্তপ্লাবী ঐশ্বর্যের ভার

আজো হেরি এরস-মাতার।

আর্টেমিস্, হিপোলিটসেরে

সঞ্জীবনী দিলে তো সেবার।

আর্টেমিস, প্রার্থনা আমার।

 

১৯৩০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


কবিকল্পলতা অনলাইন প্রকাশনীতে কবিতার আড্ডায় আপনার স্বরচিত কবিতা ও আবৃত্তি প্রকাশের জন্য আজ‌ই যুক্ত হন।